Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

সাংবাদিকতা: টাকার বিনিময়ে আইডি কার্ড

সোলেমান আহমেদ মানিক 

ডিসেম্বর ১, ২০২০, ১০:৪০ এএম


সাংবাদিকতা: টাকার বিনিময়ে আইডি কার্ড

সমাজের দর্পন হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকতা পেশাটি যেমন মহান তেমন অত্যন্ত দায়িত্বশীলও, এই পেশার কাজে কিছু ঝুঁকি থাকলেও মজাও কিন্তু কম নয়। ফলে হাজার পেশার ভিড়ে এই পেশাটি একজন ব্যক্তির আলাদা ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে থাকে। 

তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সারা বিশ্বব্যাপী আমাদের দেশেও পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও রেডিওর সংখ্যা কম নয়।

সম্প্রতি কিছু নতুন টেলিভিশন ও রেডিওর অনুমোদন দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। একে একে প্রচারেও আসছে এগুলো। তবে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। তারপর রয়েছে কয়েকশ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিকসহ কিছু পত্রিকা। আর অনলাইন নিউজ পোর্টালের তো সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই। সারা দেশব্যাপী নিউজ পোর্টালের রেজিস্ট্রেশনের আবেদন পরেছে প্রায় ১৮০০০ এর অধিক।

দেশে জাতীয় দৈনিকের সংখ্যা কয়েকশ থাকলেও সাধারণ মানুষ মাত্র ২০-৩০টি পত্রিকাকে চিনে। অন্যান্য প্রত্রিকা গুলোর নাম পরিচয় মানুষ খুব একটা জানেনা বা বাজারেও সচরাচর কিনতে পাওয়া যায়না। এদের অনেক পত্রিকাই নিয়মিত প্রকাশিত হয়না। এই সকল পত্রিকাগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বলা হয়। 

এমনই কিছু পত্রিকা টাকার বিনিময়ে যাচাই-বাছাই ব্যতীত সাংবাদিক পরিচয়ের আইডি কার্ড দিয়ে দেয়, আর কার্ড গ্রহীতা নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। অনেক সময় এসব কার্ডধারী সাংবাদিকদের নানান অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রশাসন বা স্থানীয় জনতার হাতে আটক হতেও দেখা যায়। যাতে ঢালাওভাবে অপমানিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হন সাংবাদিক সমাজ। 

বিশেষ করে মফস্বলে এই বিষয়টি বেশি পরিলক্ষিত হয়। আজকাল চোর-বাটপার থেকে শুরু করে অটো ড্রাইভার, ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছেও প্রেস কার্ড পাওয়া যায়। প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নানান অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে যায় তারা। যে কোন সমস্যায় পরলে তখন তারা তাৎক্ষণিক সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার অপচেষ্টা করে। অনেক সময় পুলিশের ও জনতার হাতে আটক হওয়া কথিত ভূয়া সাংবাদিকদের কাছেও ওই সকল আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার প্রেস কার্ড পাওয়া যায়। 

এমন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ডধারী লোকেরা যখন সাংবাদিক পরিচয়ে অপকর্ম করে বেড়ায় তখন প্রকৃত সাংবাদিকদেরও বিপাকে পরতে হয়। লোকেরা একজন প্রকৃত সাংবাদিককেও ওই অপকর্মকারী ব্যক্তির সাথে তুলনা করে। এতে করে প্রকৃত সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন। 

শুধুমাত্র ঐ সকল পত্রিকাগুলো সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে যে কাউকে সাংবাদিক বানিয়ে দিচ্ছে। পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পোর্টালেই সীমাবদ্ধ নয় এরকম হরেকরকম আইপি টিভির সাংবাদিককেও দেখা যায় যারা বিশেষ প্রতিনিধি পরিচয়ে গোটা জেলা আর স্টাফ রিপোর্টার পরিচয়ে সমগ্র দেশ চষে বেড়ান। যা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিকে অবগত করার কথা থাকলেও অনেকেই তা জানান না। প্রকৃতপক্ষে একজন জেলা প্রতিনিধি তার গোটা জেলার খবর সংগ্রহ করবে ও উপজেলা প্রতিনিধি তার নির্দিষ্ট উপজেলার সংবাদ সংগ্রহ করবে। কিন্তু সেই জায়গায় যখন বিশেষ প্রতিনিধি হয়েও সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে না জানিয়ে গোটা জেলা-উপজেলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান তখন এ নিয়ে জেলা-উপজেলা ও বিশেষ প্রতিনিধির মধ্যে দ্বন্দ চলে তখন তাদের দিয়ে সঠিক সাংবাদিকতা কতটুকু হবে এবং বিশেষ প্রতিনিধি বা স্টাফ রিপোর্টার হয়েও কেন সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে না জানিয়ে পুরো জেলা বা দেশ চষে বেড়ান এ বিষয়টিও যথেষ্ট ভাবার বিষয়।

গণমাধ্যম গণমানুষের কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই গণমাধ্যমে যখন প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন সাংবাদিকের বদলে কোন অযোগ্য অসাংবাদিক নিয়োগ করে টাকার বিনিময়ে তখন সেই ব্যাক্তি আসলে কতটা গণমানুষের কথা বলতে পারবে এ বিষয়টি যথেষ্ট সন্দিহান। 

যতটুকু জানা যায়, জাতীয় বা বিভাগীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা করতে হলে সাংবাদিকতার উপর পড়াশুনা থাকতে হয়। আর মফস্বলে সাংবাদিকতা করতে হলে সাংবাদিকতায় পড়াশুনা না থাকলে তার সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অথচ এসব না দেখে এমন কিছু লোককে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যে জীবনে কখনো সাংবাদিকতা করেনি, জীবনে কোথাও এক লাইন লিখেনি, সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে পরচিত কোন সাংবাদিক ভাইয়ের মাধ্যমে পত্রিকা বা টিভি অফিসে নিউজ পাঠায় আর নিজে বাড়িতে ঘুমায়। সে আদৌও জানে না কি নিউজ তার মেইল থেকে পাঠানো হয়েছে? বা সংশ্লিষ্ট নিউজের কোন তথ্য উপাত্ত কিছুই তার জানা থাকে না। অথচ তার নামে দিব্যি নিউজ প্রকাশিত হচ্ছে। সেও নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, এই অসাংবাদিক দ্বারা দেশের গণমানুষ আসলে কতটা উপকৃত হবে তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন।

আমি প্রথম লেখালেখি শুরু করি স্কুল ম্যাগাজিন থেকে, তারপর প্রথম আলো বন্ধুসভার পাতায় প্রথম প্রকাশিত লেখাটি দেখার পর সে যে কি অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ২০১৪ সাল থেকে সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে থেকে স্থানীয় সাপ্তাহিক শ্রীমঙ্গলের চিঠি ও দৈনিক খোলা চিঠি পত্রিকা গুলোতে লিখার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়েছিল। যদিও স্থানীয় অনেক পত্রিকাও কার্ড বানিজ্য করে থাকে, আমি নিজেও এক সময় ৩০০ টাকা দিয়ে একটি লোকাল পত্রিকার কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম। 

এরপর জাতীয় কোন দৈনিকে লেখার আগ্রহ দেখা দিল। আগ্রহ জানালাম সিনিয়র এক সাংবাদিক সাহেবকে যে কিভাবে আমি তা করতে পারি আপনার পরামর্শ চাই। উনার পরামর্শ শুনে আমার আগ্রহের সেখানেই ভাটি পরে। উনি জানালেন চাইলেই কোন জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হওয়া যায় না। এর জন্য অনেক তদবির লাগে আর মিনিমাম ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগে। শুনে আমি হতবাক। 

তবুও হাল ছাড়িনি এর কাছে ওর কাছে (বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিনিধি) গিয়ে সময় দিতাম। আমার মোটরসাইকেল থাকায় অনেকেই আমাকে তাদের সাথে নিয়ে যেতেন। কিন্তু কোন জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হবার স্বপ্ন আমার স্বপ্নই থেকে গেল। স্থানীয় পত্রিকায় নিয়মিত লেখে গেলাম। হঠাৎ এক বড় ভাই জানালেন যে জাতীয় দৈনিক আমার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। আমি চাইলে যোগাযোগ করতে পারি। আমিও উনার কথা শুনে পত্রিকা থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে মফস্বল সম্পাদকের সাথে কথা বলে আমার আগ্রহ প্রকাশ করি। উনি আমার সব কথা শুনে ইমেইলে সিভি পাঠিয়ে নিউজ পাঠাতে বললেন। নিউজের মান যাচাই করবেন। আর সিভি নিয়ে সরাসরি দৈনিক আমার সংবাদ অফিসে গিয়ে দেখা করতে বললেন। যেই কথা সেই কাজ, সিভি ইমেইল করে নিউজ দিলাম নিউজ প্রকাশিত হলো। আমার আনন্দের আর সীমা রইলো না। 

এরপর আমি সিভিসহ দৈনিক আমার সংবাদ অফিসে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করি। উনারা আমার সাংবাদিকতার উপর সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি মোটামুটি তাদেরকে উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলাম। আসার সময় আমার আইডি কার্ড চাইলাম। বললেন আপনি যান কাজ করুন, সময় হলে আইডি কার্ড দেয়া হবে। প্রায় ছয় মাস আমাকে অবজারভেশনে রেখে তারপর আমাকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ ও আইডি কার্ড দিলেন। এতে অফিসে আসা যাওয়া ছাড়া আমার একটি পয়সাও লাগেনি। 

তাহলে কার্ড নিতে পয়সা দিতে হয় এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, যোগ্যতা থাকলে আপনি অবশ্যই মূল্যায়ন পাবেন। আমারও প্রায় ছয় বছর অতিবাহিত হতে চললো জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হিসেবে। 

অপ-সাংবাদিকতাকে রুখতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা গুলোকে রুখতে হবে। টাকার বিনিময়ে কার্ড বিক্রি আর অনুমোদন বিহীন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ দণ্ডনীয় অপরাধ। এদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে সমাজের দর্পন সাংবাদিকেরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন পাবেন। 

সোলেমান আহমেদ মানিক, সংবাদকর্মী 

আমারসংবাদ/কেএস