Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪,

আজ অমর একুশে

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫, ০৭:৩৩ পিএম


আজ অমর একুশে

 

আজ অমর একুশে। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের, এমনকি মানব ইতিহাসের এক অনন্য দিন। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাঙালি। দিনটি তাই বিশ্বজুড়েও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।

মোস্তফা কামালের ‘ভাষা আন্দোলন, সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন’ শীর্ষক গ্রন্থসহ ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হোমরা-চোমরা’ ব্যক্তিদের ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ পুনঃপুনঃ এমন বক্তব্যের পর ওই সময় ছাত্র-শিক্ষকসহ সুধী সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চাপা জনরোষ এক সময় বাঁধভাঙ্গা আন্দোলনের রূপ নেয়। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর সংগঠিত ভাষা আন্দোলনে এক সময় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের অব্যবহিত পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে এ জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীরা ফুঁসে উঠতে থাকে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করতে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাইকযোগে প্রচার করে ‘আগামী এক মাস ১৪৪ ধারা চলাকালে কোনো মিটিং-মিছিল করা চলবে না। এমনকি পাঁচজন একত্রে হাঁটাচলাও করতে পারবে না।’ ঐ দিন রাতেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্রসভা ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা স্লোগানে অগ্রসরমান একটি মিছিল বিকাল ৪টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হোস্টেলের সামনে পৌঁছলে পুলিশ অতর্কিতে গুলীবর্ষণ করে। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউর প্রমুখ। তাদের বুকের তাজা রক্তে ভেসে যায় পিচঢালা রাজপথ। বৃক্ষশাখের পলাশ-শিমুল হয়ে ওঠে আরো লাল। এই খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভ প্রতিবাদে তেঁতে ওঠে সেদিনকার শীতার্ত প্রকৃতি। সেই থেকেই আমরা পেয়েছি ‘অ আ ক খ’ আপন করে। এ ঐতিহাসিক আন্দোলনের বীজমন্ত্র থেকেই বাংলাদেশীরা স্বাধিকার আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।   

মায়ের ভাষার জন্য জীবন দানের নজির পৃথিবীতে তুলনারহিত। মহান বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং বিশ্বজোড়া মানুষের মধ্যে ভাষা প্রেম জাগিয়ে তুলতে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর ২০০০ সাল থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্যের ওপর দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর শক্তিমান ও সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর এটি একটি বড়ই সুখের বিষয়। ভাষাবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম। যেখানে চীনা ভাষা ‘মান্দারিন’ প্রথম। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ইংরেজির স্থান তার অনেক নিচে। তারপরও বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা পাচ্ছে না। এ জন্য অনেকেই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। কেউ বা বলছেন, এর কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি।

প্রসঙ্গত, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের চরম পরিণতি ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটলেও এর উত্তাপ ছিলো মাসের শেষ দিনগুলোতেও। এমএ বার্ণিকের ‘ভাষা-আন্দোলন সারগ্রন্থ’ শীর্ষক বইয়ে বর্ণিত হয়েছে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একুশের শহীদের স্মরণে গায়েবী জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় হাজার হাজার শোকার্ত মুসল্লি শরীক হন। জানাযা শেষে এক সংক্ষিপ্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগের দিনের ঘটনার প্রতিবাদে এদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলীবর্ষণে অন্তত ৪ জন শহীদ ও শতাধিক আহত হয়।

এদিন ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ স্থানে একুশের ঘটনার প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয় এবং ঢাকা শহরের প্রত্যেক মসজিদে জুমার নামাযের পর শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় হাজার হাজার মানুষ শরীক হন। ভাষা-আন্দোলনের কর্মীদের ওপর পুলিশী হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২২শে ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকায় লাগাতার হরতাল কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৩শে ফেব্রুয়ারি পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের প্রচেষ্টায় ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি ২৪শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা মৌলবী মাহবুবুর রহমান।

কর্মসূচি : অমর একুশের প্রথম প্রহরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন স্পীকার, মন্ত্রী পরিষদ, বিভিন্ন সরকারি দফতরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি দিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া মাহফিল, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ : ক্ষমতাসীন দলটির নেয়া দুদিনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির প্রথম দিনে আজ রয়েছে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ভোর সাড়ে ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন।

বিএনপি : তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এ দলটি এবার রাষ্ট্ররোষে পড়ার পরও দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে রাজধানীর বলাকা সিনেমা হলের সামনে একত্রিত হয়ে শহীদ মিনারের উদ্দেশে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : সকাল সাড়ে ৬টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে ভিসির নেতৃত্বে সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রভাতফেরি শেষে মৌন মিছিল করে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

বাংলা একাডেমি : অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমান্তরালে কর্তৃপক্ষ সকাল সাড়ে ৭টায় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর ও বিকেল ৪টায় মেলার মূল মঞ্চে অমর একুশে বক্তৃতার আয়োজন করেছে।

তমদ্দুন মজলিস : বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাব কনফারেন্স লাউঞ্জে আলোচনা সভা ও মাতৃভাষা পদক প্রদান অনুষ্ঠিত হবে। তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে এ বছর মাতৃভাষা পদক পেয়েছেন ভাষা আন্দোলনে রফিক উদ্দিন আহমেদ (মরণোত্তর), বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ (মরণোত্তর), বাংলা চলচ্চিত্রে আমজাদ হোসেন, বাংলা সঙ্গীতে ফেরদৌসী রহমান এবং ভাষা আন্দোলন গবেষণায় বশীর আল-হেলাল।

শিল্পকলা একাডেমি : বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অংশগ্রহণে বিভিন্ন ভাষায় সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেলা ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদ্বোধনী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং একাডেমি প্রাঙ্গণ নন্দনমঞ্চে সন্ধ্যা ৬টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শহীদ মিনারে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি।

অমর একুশে নির্বিঘ্নে পালন করতে নেওয়া হয়েছে চার স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রতিটি প্রবেশপথ থেকে শুরু করে পুরো শহীদ মিনার এলাকায় বসানো হয়েছে ১১২টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা হুমকি পর্যালোচনা করে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে সবার শ্রদ্ধা নিবেদন নিশ্চিত করতে ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে।