সিলেট-সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে৷ জেলা প্রশাসনের হিসাবে ৯০ শতাংশ মানুষ বাড়িতে ফিরেছেন৷ কিন্তু বাড়ি ফিরেও কষ্টের শেষ নেই৷ খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, ক্ষতিগ্রস্ত ঘর সংস্কারে এখন তাদের নাভিশ্বাস৷
অনেকেই আবার আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে গিয়েছেন৷ কারণ বাড়িতে ফিরে নেই খাওয়ার নিশ্চয়তা, বাড়ি সংস্কারে হাতে নেই কোন টাকা৷ সামনে কী করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাদের৷ সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চললেও দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন৷ গত চার দিন সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে৷
গত বুধবার বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো পানির নিচে৷ ত্রাণের হেলিকপ্টার দেখে শত শত মানুষ ভিড় করছেন৷ তাদের অভিযোগ অপেক্ষাকৃত কাছের এলাকাগুলোতে অনেকেই ত্রাণ দিচ্ছেন৷ কিন্তু দুর্গম এলাকায় কেউ যাচ্ছেন না৷
সিলেটের ভোলাগঞ্জের বর্ণি গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধা পেয়ারা বেগম ভোলাগঞ্জ রাস্তার পাশে এসেছেন ত্রাণের খাবার নিতে৷ বৃহস্পতিবার বিকেলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় পেয়ারা বেগম বলছিলেন, তার বাড়িতে এখনও কোমর সমান পানি৷ দু' বেলা খাবারের জন্যই এখন তার সংগ্রাম৷ তার সঙ্গে ত্রাণ নিতে এসেছেন হাফিজুন নেছা৷ সত্তরোর্ধ্ব এই নারী বললেন, ঘরে এখনও হাঁটু পর্যন্ত পানি, দুগর্ন্ধে থাকা যায় না৷ সেখানেও নেই কোনো খাবারের ব্যবস্থা৷ রিলিফ দেওয়া বন্ধ হলে কীভাবে চলবেন তা নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা৷ ওই এলাকায় ত্রাণের নৌকা বা গাড়ি দেখলেই ছুটে আসছেন শত শত মানুষ৷ দুই বেলা খাবারের জন্য তাদের প্রাণান্তকর যুদ্ধ৷
তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি৷ ৯০ শতাংশ মানুষ বাড়িতে ফিরে গেছেন৷ তাদের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণের কাজ চলছে৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের ঘর মেরামতে সহায়তা করা হবে৷ সেই কাজে সহায়তা করতে একটু সময় লাগবে৷’’
সবাই ত্রাণ পাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘‘সুনামগঞ্জের প্রবেশ মুখেই আমরা দুইজন অফিসারকে বসিয়ে রেখেছি৷ যারা ত্রাণ দিতে আসছেন তারা যেন বিভিন্ন উপজেলায় যান সেই নির্দেশনা তারা দিচ্ছেন৷ ফলে সবাই পাচ্ছেন৷ তবে কিছু দুর্গম এলাকায় সঠিকভাবে পৌঁছানো গেছে সেটা আমি বলব না৷’’
বৃহস্পতিবার সিলেটের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গিয়েছে, অনেকেই ফিরছেন ঘরে৷ কিন্তু তাতেও হাজার বাধা৷ আশ্রয়কেন্দ্র দুই বেলা খাবারের নিশ্চয়তা থাকলেও বাড়িতে ফিরে সেই নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তারা৷ বিপর্যস্ত বাড়িঘর কীভাবে মেরামত করবেন, তা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই৷
সিলেটের সাহেবের বাজারে ত্রাণ নিতে আসা ৫৬ বছর বয়সি মকবুল হোসেন জানালেন, তার বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে৷ কিন্তু মাটি আর বাঁশ দিয়ে বানানোর ঘর এখন সোজা করবেন কীভাবে? কোথাও কোনো কাজ নেই৷ দিন এনে দিন খেয়ে চলে তার সংসার৷ তিনি জানান, খাবারের চেয়ে বিধ্বস্ত বাড়ি ঘর মেরামতেই এখন তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রয়োজন৷
সিলেট শহরের নিচু এলাকায় এখনও পানি জমে রয়েছে৷ এইসব জায়গার মানুষ শহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এখনও রয়েছেন৷ শহরের মীরাবাজারের কিশোরীমোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইটি ভবনে ১২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে৷ সিলেট শহরের যতনপুর এলাকা থেকে এসে দুই সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন ৩৮ বছরের সুফিয়া বেগম৷
আলাপকালে এই নারী বললেন, ‘‘মাসে তিন হাজার টাকায় একটি বস্তিঘরে থাকতাম৷ এখনও ঘরে হাঁটু পর্যন্ত পানি৷ দুগর্ন্ধে ওই এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না৷ এই আশ্রয়কেন্দ্রে তাও কিছু খাবার পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ি ফিরলে আমরা কী খাব? আমার স্বামী একটি সবজির দোকানে কাজ করতেন৷ মালিকের সব সবজি পচে গেছে৷ এখনও দোকান চালু হয়নি৷ এখান থেকে চলে যেতে বলছে, আমরা কোথায় যাব? সন্তান দু'টিকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব?’’
একই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭৬ বছরের ইসমাইল শেখ৷ খাঁ পাড়া থেকে তিনি এসেছেন৷ সন্তানরা খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে৷ আশ্রয়কেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি৷ দুই ছেলে কীভাবে আবার ঘর নির্মাণ করবে, টাকা পাবে কোথায় এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় যাচ্ছে ইসমাইল শেখের৷ কিন্তু কোনো কুল কিনারা পাচ্ছেন না৷
সিলেট শহরের শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রেও ঠাঁই হয়েছে প্রায় ১৫০টি পরিবারের৷ এখানকার অধিকাংশ মানুষ এসেছেন যতনপুর থেকেই৷ ৪৬ বছরের আসিয়া খাতুন বললেন, ছয় জনের সংসার তাদের৷ এক ছেলে কাজের উপযোগী৷ সকালেই সে বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে৷ কিন্তু ছেলের দুইটি শিশু নিয়ে মহাসংকটে পড়েছেন তিনি৷ নিজেরা ভাত-খিচুড়ি যা খাচ্ছেন এক বছর বয়সি শিশুকেও তাই খাওয়াতে হচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত কেউ শিশুদের জন্য কোনো খাবার দেয়নি৷ হাতেও কোনো টাকা নেই যে কিছু কিনবেন৷ তিনি বলেন, এই আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ৫০টি বাচ্চা আছে৷ তাদের সবারই খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে৷ অনেক বাচ্চার পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে৷ তাদের কীভাবে চিকিৎসা হবে তারও নেই কোন নিশ্চয়তা৷
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিলেট-সুনামগঞ্জের সব এলাকা থেকেই পানি নেমে যাচ্ছে৷ এই মুহূর্তে আর কোনো শঙ্কা নেই৷ তবে বন্যা মৌসুম যেহেতু শুরু, ফলে সামনের মাসে উত্তরাঞ্চলে বন্যা হতে পারে৷ সবগুলো নদ-নদী থেকে পানি কমছে৷ আসলে বৃষ্টি কমে যাওয়ার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে৷ আগামী কয়েকদিনে আরও উন্নতি হবে৷’’
ইএফ