ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ, বিশ্ব মন্দা, খাদ্য সংকটসহ বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতির কারণে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের আসন্ন ঢাকা সফর নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া এই সময়ে বাংলাদেশেকে পাশে পেতে চাইবে। আর বাংলাদেশও চাইবে কিছু সুবিধা নিতে।
তবে বর্তমান বিশ্বে পরিস্থিতির কারণে এই সফরে নতুন খুব বেশি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সসম্পর্কের বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করেন আলোচনার মূল ফোকাস হতে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মূলত ঢাকা আসছেন ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোট- ইন্ডিয়ান ওসেন রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় যোগ দিতে।
এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের ২৩টি দেশ এর সদস্য। রাশিয়া এর সদস্য না হলেও বাংলাদেশের আমন্ত্রণে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দিচ্ছে। ২২ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই সম্মেলন ঢাকায়। বাংলাদেশ আইওআরএ-এর চেয়ার। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুইদিনের জন্য ২৩ নভেম্বর ঢাকায় আসবেন। স্বাধীনতার পর ৫০ এই প্রথম কোনো রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সফরের পিছনে রাজনৈতিক রাশিয়ার দিক থেকে উদ্দেশ্য আছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়া ক্রমেই এক ঘরে হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা ছাড়াও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এশিয়া, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের আরো ২২টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন। এটা রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর আগে গত মাসে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্স অন ইন্টারআ্যাকশন এন্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস ইন এশিয়া (সিআইসিএ) শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,"রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কের কখনো অবনতি হয়নি। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইওআরএ-এর সম্মেলনে মূলত যোগ দিতে ঢাকায় আসছেন। তারপরও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এখনকার ভূরাজনীতির কারণে তার সফর আলোচিত হচ্ছে, কৌতূহল আছে, যদিও এটা দ্বিপাক্ষিক সফর নয়। বাংলাদেশ তো যুদ্ধের অবসান চায়-এট স্পষ্ট করে দিয়েছে। রাশিয়া হয়তো আরো সমর্থন চাইতে পারে। আর রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেখানে পেমেন্টের বিষয় আছে। ডলারের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যেতে পারে। সেটা উভয় দেশের জন্য উদ্বেগের। এখানে একটা উপায় খোঁজার চেষ্টা হতে পারে।”
এছাড়া রিফাইনারি নেই বলে বাংলাদেশ রাশিয়ার জ্বালানি তেল এখন নিতে পারছেনা। কিন্তু এটা নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করা যায়। খাদ্য সংকটে রাশিয়ার খাদ্যশস্যেও বাংলাদেশের লাগতে পারে। রাশিয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার আরো বড় করা যায় কী না। এসব বিষয়ে কথা বলার সুযোগ আছে বলে মনে করেণ অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তবে এজন্য বিকল্প মুদ্রার পথও বের করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাশিয়ার সমর্থন চায়। তবে সেটা নিয়ে রাশিয়ার সমর্থন কতটা পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক। তিনি বলেন,"রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক মূলত অস্ত্র বিক্রির। রাশিয়া এখন পর্যন্ত তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেনি। নতুন করে বলবে বলে আমার মনে হয় না।”
তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সফরের একটি গুরুত্ব আছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সমর্থন হয়তো তারা চাইবে। তবে বাংলাদেশ অধিকাংশ সময় ভোট দানে বিরত থেকেছে। একবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তবে এই সফরে বাইরের সম্পর্কটা আরো বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন। তার কথা,"রাশিয়ার তেল যদি অন্য কোনো দেশে রিফাইন করে বাংলাদেশ ক্রেডিটে নিতে পারে তাহলে সেটা হবে অনেক বড় সুযোগ।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন,"ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এখন ব্যাকফুটে আছে। তাই বাংলাদেশের সমর্থন তারা চাইবে। অন্যদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও এখানে থাকবেন। সেই সুযোগও রাশিয়া কাজে লাগাতে চাইবে। বাংলাদেশের অবস্থান রাশিয়া বোঝে। বাংলাদেশ সাধারণ পরিষদে তাদের পক্ষেও না, বিপক্ষেও না। তাদের চেষ্টা থাকবে বাংলাদেশ যদি একটু পক্ষে আনা যায়। ``
তিনি বলেন,"দুই দেশের এখন বড় কনসার্ন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেখানে রাশিয়ার ১৩ বিলিয়ন ডলার। এখন কাজ পিছিয়ে যেতে পারে। সেটার কী উপায় হবে সেটা নিয়েই মূল আলোচনা হবে বলে আমি মনে করি। আর বিশ্বের পরিস্থিতি তো ভালো না। তাই প্রত্যাশার জায়গা সীমিত।”
ইএফ