ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের তাবলীগী আলোচনা সভায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলায় শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম সুজন জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা ।
বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুরে বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের গেটের কাছেই এই ঘটনা ঘটে। যোহরের নামাজ শেষে রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করে বের হবার সময় তাদের ওপর হামলা করা হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
আহতরা হলেন— সাকিব আজাদ তুর্য, শাহিনুর আলম রাসেল, রাফিদ হাসান সাফওয়ান, ফাহিম দস্তগীর, রেজোয়ান আহমেদ রিফাত। তারা সবাই ঢাবির আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। হামলার সময় তারা একসঙ্গে থাকলেও সাফওয়ান ও ফাহিম সামনে থেকে সবচেয়ে বেশি মার খাওয়ার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
এদের মধ্যে শাহীন ও রেজওয়ান ও সাকিব গুরুতর আহত হন। শাহীনকে মেরে মুখ থেতলে দেয়া হয় এবং তাদের হাত ও মুখে ক্ষত হয়েছে। রেজওয়ানের মুখে উপর্যুপরি ঘুষিতে ঠোঁট কেটে গেছে এবং কোমরে ও পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। সাকিবকেও রাস্তায় ফেলে মারা হয়, তারও মুখ ফেটে যায়ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম দেখা যায়। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা ২১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদের ডান হাত বলে পরিচিত শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো. তাওহীদুল ইসলাম ওরফে সুজন। রাজনীতিতে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ডুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, আইন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী জোহরের নামাজ পড়তে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারে আসেন। এসময় তারা নামাজের শেষেই রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে বাধা দেন বঙ্গবন্ধু টাওয়ার কর্মচারী সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। এখানে আলোচনা করা উপাচার্য ও প্রক্টর থেকে নিষেধ করা আছে এবং সেন্ট্রাল মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও রমজানের আলোচনা করা যাবে না বলে জানান। এসময় সেখানে শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম সুজন এসে তাদের মসজিদ থেকে বের হতে বলেন।
পরে শিক্ষার্থীরা মসজিদ থেকে বের হয়ে সেন্ট্রাল মসজিদের দিকে যেতে চাইলে গেটের মুখেই তাওহীদুল ইসলাম সুজন ও তার অনুসারীরা তাদের উপর হামলা করে। তাদেরকে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি দিতে থাকেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় গেটের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি গেট বন্ধ করে দিলে তারা বিভিন্ন দিকে দৌড়ে পালাতে থাকেন। পরে কয়েকজন কোনভাবে গেট দিয়ে ঢুকে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করেন।
ভুক্তভোগী আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শামীম শহীদী বলেন, আমার তাবলীগের বন্ধু ও বড় ভাইয়েরা রোজার আমল ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করতে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারের মসজিদে আসি। আমরা আগেই এটা প্রচার করেছি যে আমরা রোজার ফজিলত, মাসলা মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু হঠাৎ অপরিচিত কয়েকজন মসজিদে এসে আমাদের বের হতে বলে। তাছাড়া টাউয়ারের কর্মচারীরাও আমাদের চলে যেতে বললে আমরা বের হই। এসময় আমরা গেটের কাছাকাছি আসতেই ৩০/৪০ জন আমাদের উপর হামলা করে। পরে আমরা জানতে পারি তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলো। তাবলীগের উপর ছাত্রলীগ হামলা করবে আমরা ভাবতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের গেট দারোয়ান বলেন, শিক্ষার্থীরা বাইরে বের হতে না হতেই আগে থেকে পাশে অপেক্ষা করা কিছু ছেলে তাদের উপর হামলা করে। এসময় কয়েকজনকে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। তাদের কয়েকজনের হাতে লাঠি ভহিলো পরে তারা সেগুলো ফেলে কিল, ঘুষি লাথি দিতে থাকে। কয়েকজন শিক্ষার্থী বাইরে পালিয়ে যায় আর কয়েকজন ভবনেই আশ্রয় নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের আইন বিভাগের মসজিদে জামাতে নামাজের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় আমরা বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের মসজিদে নামাজ পড়ি। তারপর আমাদের মাস্টার্সের তাবলীগের একজন ভাই রমজানের তাৎপর্য সম্পর্কে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এরপর কর্মচারী সমিতির সভাপতি ও একজন লোক আমাদের সেন্ট্রাল মসজিদে যেতে বলেন। এসময় আমরা বের হয়ে গেটে আসার সঙ্গেসঙ্গেই শহীদ মিনারের দিক থেকে ৩০/৪০ জন পোলাপান এসে আমাদের উপর হঠাৎ হামলা চালায়। আমাদের অনেকেই আহত হয়েছে। দুই তিনজনকে রাস্তায় ফেলে লাথি, কিল ঘুষি দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু হল ও জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের দুজনকে আমি চিনতে পেরেছি তবে তাদের নাম জানি না।
তিনি বলেন, এসময়ে সবাই যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছি। আমার বন্ধু এই ভবনেই সাবলেট থাকে, আমি তার এখানে আশ্রয় নিয়েছি। প্রথম বর্ষে পড়ি, এত খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বো বুঝতে পারিনি। নামাজ পড়তে এসে তাবলীগের আলোচনা করার জন্য যদি আমাদের উপর হামলা করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়?
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আহত শিক্ষার্থী রেজওয়ান ঘটনার ৪০ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু টাওয়ার থেকে নামছেন। তার পায়ে ও কোমরে গুরুতর জখম দেখা যায়, তাছাড়া তার ঠোট ফেটে রক্ত পড়ে তা জমাট বেধে থাকতে দেখা যায়৷ তিনি বলেন, আমরা নামাজের শেষে বের হতে না হতেই আমাদের উপর হামলা করা হয়েছে। আমিসহ আরও কয়েকজন তাবলীগের বন্ধুকে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়েছে। পরে কোন উপায় না দেখে বন্ধুর সাথে বঙ্গবন্ধু টাউয়ারের একজনের বাসায় আশ্রয় নেই। আমাদের বন্ধু শাহীন আরও গুরুতর আহত। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত তাওহীদুল ইসলাম সুজন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, `এ ঘটনায় আমি কোনো ভাবেই সম্পৃক্ত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে আমি কেন মারতে যাবো। আমি শুনলাম ফেসবুক থেকে আমার নাম ছবি নিয়ে আমার নামে এগুলো ছড়ানো হচ্ছে। এর পেছনে তাদের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে তবে আমি কিছুই জানি না। ঘটনা একেবারে বানোয়াট ও মিথ্যা। আমি অসুস্থ, আমার দাঁতে ব্যাথা আমি তাদের মারতে যাবো কেন? তাছাড়া তখন আমি ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম।`
আরএস