কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আত্মস্বীকৃত আলবদর কমান্ডার কেএম আমিনুল হক ওরফে রজব আলীর ফাঁসি রায় কার্যকরের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার (৪ জুলাই) দেওঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও শহীদ পরিবারের উদ্যোগে বিকাল ৪ ঘটিকায় উপজেলার সাভিয়ানগর বাজারে মানববন্ধনে আয়োজন করা। উক্ত মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সর্বস্তরের সাধারণ মানুষজন।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেএম আমিনুল হক ওরফে রজব আলীর সার্বিক আগ্রহে ও সহযোগিতায় অষ্টগ্রাম উপজেলার দেওঘর ইউনিয়নের সাভিয়ানগর চৌধুরী বাড়ী ও খাঁ বাড়িতে রজব আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে জঘন্যতম এক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যায় ২৭ জন নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়, এরমধ্যে হত্যাকান্ডের শিকার ১৭ জন হচ্ছে সাভিয়ানগর বাজারের নিকটবর্তী দুটি বাড়ি চৌধুরী বাড়ী ও খাঁ বাড়ির মানুষজন।
কেএম আমিনুল হক ওরফে রজব আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ এলাকায় বাংলাদেশের নিরীহ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যাসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নেন।
তিনি ভৈরবে একটি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তানি ইসলামি ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভৈরবে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এলাকায় ‘আলবদর’ বাহিনী গঠন করেন এবং কিশোরগঞ্জ জেলার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার কৃষ্ণপুর, গদাইনগর ও চন্ডিপুর গ্রামে এবং কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার সদানগর ও সাবিয়ানগর গ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক এলাকায় গণহত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন ও নির্যাতন করেন। এছাড়াও স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের অপহরণ করে রাজাকার ক্যাম্পের টর্চার সেলে নির্যাতন করে হত্যা করেন।
আমিনুল হক ওরফে রজব আলী ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৭২ সালে তার বিরুদ্ধে অষ্টগ্রাম থানায় দালাল আইনে তিনটি মামলা হয়। মামলাগুলোতে তার ৪০ বছর সাজা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় ১৯৮১ সালে মাত্র ১০ বছর সাজা ভোগ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
১৯৮২ সালে জেল থেকে বের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ও বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার পাকিস্তান যান। ১৯৯৭ সালে তিনি নিজ এলাকা ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। একবার সে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে এলাকায় এসে জনতার ধাওয়া খেয়ে এলাকা ত্যাগ করলে আর কখনো জন্মভূমিতে আসেনাই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর কে এম আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।
২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এসব অভিযোগের তদন্ত শেষে তদন্ত সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে ২০১৬ সালের ১৮ মে ট্রাইব্যুনাল আমিনুল হকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর কে এম আমিনুল হককে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। আগে থেকেই পলাতক মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এ আসামিকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব।
২৫ বছর ঢাকায় আত্মগোপনে থাকার পর চলতি মাসের শনিবার (২ জুলাই) রাতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
আত্মগোপনে থাকাকালে তিনি সাধারণত জনসমাগম, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও তার ব্যক্তিগত পরিচয় প্রকাশ পায় এমন স্থান এড়িয়ে চলেন।
গ্রেপ্তার আমিনুল ‘আমি আলবদর বলছি’ ও ‘দুই পলাশী দুই মীরজাফর’ নামে দুটি বই প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগস্টের দিনসহ সামগ্রিক বিষয়গুলো নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আত্মস্বীকৃতি হিসেবে নিজেকে ‘আলবদর কমান্ডার’ দাবি করেন। ২০১৪ সালে তার প্রকাশিত ‘দুই পলাশী দুই মীরজাফর’ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার এবং তার বিরুদ্ধে রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা হয়।
আত্মস্বীকৃত আলবদর নেতা, কুখ্যাত রাজাকার রজব আলীর ফাসির রায় কার্যকরের দাবীতে স্বজনহারা মানুষজন ৫১ বছর পর মানববন্ধন করে রাজাকার রজব আলীর ফাসির রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। দেওঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সুজন খাঁনের সার্বিক তত্বাবধানে এসময় মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৭ জন শহদী পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা, বীরমুক্তিযোদ্ধা মুমিন উল্লাহ্ সরকার, দেওঘর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. আলতাফ হোসেন প্রমূখ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ এই মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন। বক্তাগন দ্রুত এই কুখ্যাত রাজাকার আলবদর নেতা রজব আলীর ফাসি কার্যকর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
কেএস