কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে নার্সদের প্রণোদনার টাকা নিয়ে বাণিজ্য

নজরুল ইসলাম মুকুল, কুষ্টিয়া প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২২, ০৩:৫৮ পিএম

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে মহামারি করোনা ভাইরাস (কোভিড ১৯) এ আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ২৩৪ জন নার্সদের জন্য ১ কোটি ১৫ লক্ষ ৭০ হাজার ৪৬০ টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দের সম্মানীর টাকা নিয়ে চলছে বাণিজ্য। এই সরকারি টাকা বরাদ্দ আসার আগে থেকে ২৩৪ জন নার্সদের নিকট থেকে নেওয়া হয়েছে ১ হাজার করে টাকা এবং বরাদ্দের টাকা আসার পর উত্তোলনের জন্য নেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু ২ হাজার করে টাকা।

অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ফিরোজা, মুসলিমা, পারভিন ও হামিদা এরা ২ হাজার টাকা করে আদায় করছে। নাম মাত্র নার্স এসোসিয়েশনের নাম ভাঙিয়ে এসোসিয়েশনের সভাপতি ফিরোজা ও সাধারণ সম্পাদক মুসলিমার সহযোগিতায় এই টাকা আদায় করা হচ্ছে। এই কমিটি কোন প্রকার নির্বাচন ছাড়াই গঠন করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ ছাড়া ২ হাজার করে টাকা যারা দিবে না তাদের কে সম্মানীর প্রণোদনার টাকা দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিচ্ছেন তারা বলেও অভিযোগ উঠেছে। 

সূত্রে জানা যায়, মহামারি করোনা ভাইরাস (কোভিড ১৯) এ আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত নার্সদের জন্য সম্মানী হিসেবে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বাজেট -১)  শাখার  তত্বাবধায়নে বাংলাদেশে মোট ১৩ টি প্রতিষ্ঠানের ১৬৫৬ জন নার্সের অনুকুলে এককালীন সম্মানী বাবদ ৭ কোটি ৯৩ লক্ষ ১০ হাজার ৬১৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২৭ জুন এই টাকার বরাদ্দ পাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পাল। যার স্বারক নং- (৪৫.০০.০০.০০.১৩৯.০২৫.২০২২-৪৭৯)। সারা বাংলাদেশের ১৩ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ২৩৪ জন স্টাফদের জন্য ১ কোটি ১৫ লক্ষ ৭০ হাজার ৪৬০ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশের ১৩ টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি প্রেরণ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেরিত চিঠিতে আরও উল্লেখ রয়েছে, শুধুমাত্র করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত সরকারি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এ সম্মানী পাবেন। আউটসোর্সিং বা অন্য কোনোভাবে নিয়োজিত ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীগণকে এই সম্মানী প্রদান করা যাবে না। অর্থ প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান অনুকূলে অথোরাইজেশন জারির মাধ্যমে এই টাকা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ জুলাই ২০২০ আহরিত মূল বেতন অনুযায়ী দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ সম্মানী হিসেবে প্রত্যেককে প্রদান করা হবে এবং ইতোপূর্বে যারা সম্মানীপ্রাপ্ত হয়েছে তারা দ্বিতীয়বার সম্মানিত হবে না। এই চিঠি আসার পর গত ৩০ জুন কুষ্টিয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের সমস্ত স্টাফদের নিয়ে গিয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স ফিরোজা, মুসলিমা,পারভিন ও হামিদা বলেন এই প্রণোদনার টাকা তুলতে গেলে ১০% টাকা হিসাব রক্ষন অফিসে দিতে হবে। হিসাব রক্ষণ অফিসের দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ এই টাকা কেটে নেবে। 

এ সময় উপস্থিত থাকা অন্যান্য নার্সরা বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে ঘটনাস্থলে সাংবাদিক উপস্থিত হয়ে নার্স ফিরোজা ও হিসাব রক্ষন অফিসের দায়িত্বে থাকা রাকিবুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করলে তারা অস্বীকার করেন। বর্তমানে সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য চলে যাওয়ায় তারা কৌশল পরিবর্তন করে ভিন্ন রকমভাবে নার্সদের নিকট থেকে নার্স ফিরোজা, মুসলিমা, পারভিন ও হামিদা জনপ্রতি ২ হাজার করে টাকা আদায় করছেন। যেখানে চিঠিতে উল্লেখ করা রয়েছে এই টাকা প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান অনুকুলে অথোরাইজেশন জারির মাধ্যমে বরাদ্দ প্রদান করতে হবে সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত কর্মচারীরা টাকা প্রদানের কাজ করছে এ নিয়েও সাধারণ নার্সদের মাঝে বিভিন্ন রকমের মন্তব্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছে হাসপাতাল কতৃপক্ষের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমেই তারা এই কাজগুলো করে বেড়াচ্ছেন।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, এসব টাকা নার্স ফিরোজা, মুসলিমা,পারভিন ও হামিদা হিসাব রক্ষন অফিসের রাকিবুল ইসলামের সাথে কন্ট্রাক্ট করে টাকাগুলো আত্মসাতের জন্য জনপ্রতি ২ হাজার করে টাকা আদায় করছেন। আর যারা এই টাকা দিবেনা তারা টাকা পাবেনা বলেও বলে বেরাচ্ছেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নাছিমা আক্তার প্রতিবাদ করলে ও ২ হাজার করে টাকা দিতে না চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোমেন তাকে ডেকে নিয়ে এসে প্রতিবাদ করার শাস্তি হিসেবে নাছিমাকে দায়িত্বে থাকা অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ওয়ার্ড থেকে শিশু ওয়ার্ডে বদলী করে দেন।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র নার্স বলেন, করোনাকালীন সময়ে কাজের জন্য সরকারি প্রণোদনা হিসেবে টাকা আসার জন্য ৭ -৮ মাস আগে ফিরোজা, মুসলিমা, পারভিন ও হামিদা প্রতিজনের নিকট থেকে ১ হাজার করে টাকা নিয়েছে। এখন এই টাকা আসার পর প্রত্যেকজনের ফরম ফিলাপ করে টাকা তোলার জন্য ৩ হাজার করে টাকা চেয়েছিলো। সবাই ৩ হাজার টাকা দিতে না চাইলে এখন তারা ২ হাজার করে টাকা নিচ্ছে। আর বলছে এই ২ হাজার করে টাকা না দিলে তাদের টাকা ফেরত চলে যাবে।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা হিসাব রক্ষন অফিসের রাকিবুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনর মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য করোনাকালীন সময়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার জন্য ১০% ভ্যাট কাটার কথা ছিলো। পরে স্যারের সাথে কথা বলার পর অল্প সময় থাকার জন্য টাকা কাটা হয়নি। এ ছাড়াও আমাদের অফিসের জন্য এবং আমার জন্য কাউকে কোন প্রকার টাকা দেওয়াও লাগছেনা। যদি কেউ নিয়ে থাকে সেটা তার ব্যাপার। আমি কোন টাকা নিচ্ছিনা। এই টাকা পুরোটাই তাদের দেওয়া হচ্ছে।

নার্স ফিরোজার সাথে কথা বললে তিনি জানান, আপনি কালকে অফিসে আসেন। আমি কোন টাকা পয়সা নেয়নি। আর আমি টাকা কেনো নিবো। আমার কি হয়েছে আমি টাকা নিবো।

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোমেন বলেন, এটা আমার দেখার বিষয় না। আমার কাজ শুধু সরকারি টাকা আহরণ করা এবং বিতরণ করা। কে কি করলো না করলো সেটা আমার দেখার বিষয় না। আপনাদের প্রশ্নের উত্তরে আমি বিব্রত হচ্ছি। আমাকে বিব্রত করবেন না। আমি আপনাদের সব উত্তর দিতে বাধ্য নই। তিনি বলেন, যে টাকা দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তারা দুজনেই দায়ী। আপনারা তাকে ধরেন।

কেএস