টাঙ্গাইলের বাসাইল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪১৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে। কলেজের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত চেয়ে চিঠি দেওয়ায় হাবিবুর রহমান সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দপ্তরে নামে-বেনামে মনগড়া নানা অভিযোগ দিচ্ছেন।
জানাগেছে, বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয়ে ২০০৮ সালের ১৫ মে অধ্যক্ষ হিসেবে ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান যোগদান করেন। যোগদানের পর ২০১১ সালের ২২ মার্চ তিনি পছন্দের লোকদের নিয়ে কলেজ পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। তিনি কমিটির লোকদের নিয়ে কোন সভা না করে শুধু রেজুলেশন খাতায় সাক্ষর নিয়েছেন। অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হলেও কোন প্রতিকার হয়নি।
বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে মন্ত্রণালয় ও ডিজির কাছে মনগড়া অভিযোগ দেওয়ায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান অবসরে যাওয়ার পর চলতি বছরের ১ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ময়মনসিংহ অঞ্চলের পরিচালকের কাছে ও গত ৭ মার্চ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের কাছে তিনি কলেজের ১৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর সাক্ষর নকল করে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরেজমিন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাননি। পরে গত ২৩ মে ২০২২ তিনি স্বনামে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আরও একটি সাজানো অভিযোগ দিয়েছেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়- কলেজের আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্ধারিত রেজিস্ট্রারে যথাসময়ে লেখার নিয়ম থাকলেও ২০০৮ সালে যোগদানের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান তা করেননি। ২০১৫ সালে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা ও আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে তৎকালীন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে ৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারী একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর অধ্যক্ষ যোগদানের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮ বছরের হিসাব একসঙ্গে ক্যাশ বইয়ে লিখেন। তখনও তিনি আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত সংরক্ষণ না করে অর্থ-আত্মসাতের প্রয়াস পান।
২০২০ সালে কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক অভিভাবক সদস্য আলমগীর হোসেন আবার অধ্যক্ষের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। ২০২১ সালে তিনি বাধ্য হয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব ক্যাশ বইয়ে লিখেন। কিন্তু আয়-ব্যয়ের হিসাবে গড়মিল দেখা দেওয়ায় তিনি ব্যাকডেটে ভাউচার তৈরি করে তা সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। তিনি ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর সর্বশেষ কলেজ গভর্নিং বডির সভা করেন এবং অবসরে যাওয়ার আগে এক বছরের মধ্যে কলেজ গভর্নিং বডির কোন সভা করেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য উচ্চ শিক্ষা ও মাধ্যমিক অধিদপ্তরে পাঠান। বিষয়টি জানাজানি হলে মহাবিদ্যালয়ের দাতা সদস্যরা প্রতিবাদ করায় তাদেরকে মহাবিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। পরে ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাসাইল এমদাদ-হামিদা মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বাসাইল ডিগ্রি কলেজ করা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান কলেজ গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত ব্যতীত ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন বর্ষের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০ লাখ ৭৪ হাজার ১০০ টাকা কোচিং ফি আদায় করেছেন এবং ওই টাকা কলেজের নগদান হিসাব বইয়ের আয়-ব্যয়ে লিপিবদ্ধ করেননি।
কলেজের বিতরণবই পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ওই টাকা থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়- অবশিষ্ট ৮ লাখ ৯৪ হাজার ১০০ টাকা কলেজের গোপন হিসাব নম্বর(নং-০২০০০০৪৬৫৫২৭১, বাসাইল শাখা, অগ্রণী ব্যাংক) থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি তিন মাস পর অভ্যন্তরীণ অডিট করানোর নিয়ম থাকলেও তিনি ১৩ বছরের অধিককাল সময়ে কোনো প্রকার অডিট করাননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দিয়েও কোনো অডিট করাননি।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন মতে, অডিট না করিয়ে নানাভাবে কলেজের ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪১৭ টাকা সাবেক অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান আত্মসাৎ করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত চেয়ে ডক্টর মো. হাবিবুর রহমানকে একাধিকবার চিঠি দিলেও তিনি ওই চিঠি গ্রহণ করেননি এবং কোন উত্তরও দেননি।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৯ মাস পূর্বে অবসরে গিয়েছি। এ সময় আমার কাছে কেউ চার্জ বুঝে নেয়নি। আত্মসাৎ বা অনিয়মের কোন বিষয়ই সত্য নয়। যদি অনিয়মের কোন বিষয় থাকে তাহলে ডিজি বা অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি কাজী অলিদ ইসলাম বলেন, ‘আমি সভাপতি হয়ে আসার আগে এডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিটের নির্দেশনা দেন। অডিটে সাবেক অধ্যক্ষ ডক্টর মো. হাবিবুর রহমানের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ওঠে এসেছে। এ মর্মে টাকা ফেরত চেয়ে তাকে বার বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কোন সাড়া না পেয়ে তারা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
আমারসংবাদ/এসএম