টাঙ্গাইলের বাসাইলের দাপনাজোর গ্রামে ব্যক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত একটি রিসোর্টের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এমপিওভুক্ত একটি বালিকা বিদ্যালয়। সেই সাথে সামাজিক, মানসিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে বিদ্যালয়ে পড়ুয়া উঠতি বয়সের মেয়েরা। ফলে বিশাল জায়গা জুড়ে গড়ে উঠা বিদ্যালয়টির ছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের পাশে ওয়াটার গার্ডেন রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের বেড়াতে আসা লোকজনের নানা অশ্লীলতার কারণে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে স্থানীয়রা। এলাকায় বিতর্কিত ওই রিসোর্টের আলাদা কোন ফটক না থাকায় বালিকা বিদ্যালয়ের উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী সেখানে প্রবেশ করছে।
এছাড়াও রিসোর্টে আসা উঠতি বয়সী যুবক-যুবতীদের নানা অশ্লীল চলাফেরা, আচরণ ও প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক ব্যক্তিগত যানবাহন অবাধে চলাচল এবং পার্কিয়ের কারণে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশ দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে অভিবাবকরা মেয়েদের অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছে স্কুলের কতৃপক্ষ।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার দাপনাজের গ্রামের স্থপতি আখতার হামিদ মাসুদ তার মায়ের নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং তার নরওয়ের বন্ধু কার্ল ফ্রেডরিক লিন্ডষ্ট্রমের কাছে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। নরওয়ের নাগরিক ফ্রেডরিক সাথে সাথে সেই স্কুলটাকে দুই বন্ধুর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেন। সেই মোতাবেক ১৯৯২ সালে দুই বন্ধু তাদের দু’জনের মায়ের নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তারা এ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন ‘মার্থা লিন্ডস্ট্রম-নুরজাহান বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’।
এর আগে বাংলাদেশে নরওয়ে দূতাবাসের পদস্থ কর্মকর্তা ও নরওয়ের নাগরিক কার্ল ফ্রেডরিক লিন্ডষ্ট্রম তার বন্ধু আখতার হামিদ মাসুদের আমন্ত্রণে দাপনাজের গ্রামে বেড়াতে আসেন। সবুজে ঘেরা ছায়া শ্যামল দাপনাজোর গ্রামের মানুষের আতিথিয়তায় মুগ্ধ হন তিনি। এরপর সময় পেলেই এ গ্রামে বেড়াতে আসতেন। এভাবে গ্রামের মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে দাপনাজোর গ্রামের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ্রহ থেকে তিনি তার মা ও বন্ধুর মায়ের নামে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়ের জমিদাতা আখতার হামিদ মাসুদ ও বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতা আবুল কালাম মোস্তফা লাবু। এছাড়াও সে সময়ে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়ান টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট কবি ও লেখক এবং কলেজ শিক্ষক মাহমুদ কামালসহ স্থানীয় অনেকে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি।
১৯৯৩ সালের ৯ এপ্রিল খুবই জাকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্যদিয়ে স্কুলের উদ্বোধন করা হয়। সেদিন দেশী-বিদেশী মেহমানদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে দাপনাজোর গ্রাম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নরওয়ের এদেশীয় কাউন্সিলর মি. রোয়ার উইক, ডেপুটি কাউন্সিলর টোরেং টোরেং ও মি. হোলটিনসহ নরওয়ের ৩৫ জন নাগরিক দাপনাজোর গ্রামে আসেন। বিদেশীদের পদচারনা ও স্থানীয়দের আনন্দ উৎসবের মধ্যদিয়ে স্কুলটির শ্রেনীকক্ষে পাঠদানের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ব্যাক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত একটি রির্সোর্ট ও স্পা সেন্টারের কারণে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের মনোরম পরিবেশে বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠা এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনাম অর্জন করে। মানসম্মত শিক্ষাদান ও চমৎকার পরিবেশের কারণে দাপনাজোর এলাকা ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্রীরা ভর্তি হতে শুরু করে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে স্কুলটি। একপর্যায়ে সরকারী এমপিওভুক্ত হয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি।
বর্তমানে সরকারী অর্থায়নে একটি সুদৃশ্য দোতলা ভবন, বিশাল খেলার মাঠ ও প্রধান শিক্ষকের আবাসিক ভবন রয়েছে এখানে। স্কুলের ছাত্রীর সংখ্যা আশি থেকে নব্বই জন। যদিও এক বছর আগে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক। রিসোর্টের কারণে বর্তমানে ছাত্রীর সংখা ৮০ থেকে নব্বই জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও শিক্ষক ও কর্মচারী মিলে প্রায় ১৭ জন দায়িত্ব পালন করছে।
এলাকাবাসী জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে দাপনাজোর গ্রামের ড. আহসান মনসুর স্কুলের জায়গা ও আশপাশের কৃষি জমি নিয়ে ওয়াটার গার্ডেন রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টার নামের একটি রিসোর্ট এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালের শেষের দিকে রিসোর্ট এর কার্যক্রম শুরু হয়। রিসোর্টের নির্মাণ কাজ চলাকালীন সময়ে এলাকাবাসীদের বলা হয় এখানে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করা হবে। রিসোর্ট এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর এলাকাবাসী জানতে পারে এখানে রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও সে সময় এ বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না স্থানীয়রা।
কিন্ত রিসোর্টের বর্তমান কার্যকলাপ ও এর কারণে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ক্ষতির মুখে পড়ায় টনক নড়েছে এলাকাবাসীর।
সম্প্রতি সরেজমিনে মার্থা লিন্ডস্ট্রম-নুরজাহান বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, রিসোর্ট এর আলাদা কোন রাস্তা নেই। স্কুলের প্রধান ফটক দিয়ে নানা বয়সী নারী-পুরুশ প্রবেশ করছে। উঠতি বয়সী উচ্ছৃংখল ছেলে মেয়েদেরকেও মুল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এসব দর্শনার্থীরা যখন রিসোর্টে দলবেঁধে প্রবেশ করছে। সে সময় স্কুলের ছাত্রীরা টিফিনের ফাঁকে স্কুলের আঙ্গিনায় ছুটোছুটি করছে। দর্শনার্থীরা স্কুলের জায়গা দিয়ে এতে একে রিসোর্টে প্রবেশ করছে।
এছাড়ও বেশ কিছু যুবক-যুবতী স্কুলের আঙ্গিনায় বাগানের ভেতর গল্প করছে। অনেকে আবার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সবই ঘটছে রিসোর্টের বাইরে স্কুলের জায়গায়। এসব বিষয় নিয়ে অনেকদিন ধরে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা সময়ে। গত ২৮ জুলাই স্কুলের ক্যাম্পাসে বটগাছের নিচে অভিবাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম। স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা এ সময় রিসোর্টের কু-ফল তুলে ধরেন সংসদ সদস্যের কাছে। তারা অভিযোগ করেন, নানা অসামাজিক কর্মকান্ডের কারনে স্কুলের ছাত্রীর সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। রিসোর্টের জন্যে বিকল্প কোন রাস্তার ব্যবস্থা না করা হলে স্কুলটি এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। এসব অভিযোগ শুনে সংসদ সদস্য বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, রিসোর্ট মানে কি, এটি একটি আবাসিক হোটেল করা হয়েছে। একটি বালিকা বিদ্যালয়ের সাথে এই হোটেলটি করা হয়েছে। আমরা এলাকার বাইরে যেতে পারেনি না, এই হোটেলের কারণে। মানুষ খারাপ কথা বলে। এই হোটেলে অনৈতিক সকল কাজ চলে। আমাদের এই বালিকা বিদ্যালয়টি বাসাইল উপজেলার মধ্যে একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পাশে এমন একটি হোটেল করা কোন ভাবেই ঠিক হয়নি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় একজন অভিযোগ করেন, রিসোর্ট এর মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। বর্তমানে এ রিসোর্টে অনৈতিক কার্যকলাপ হচ্ছে। এতে করে আমাদের এলাকার নাম খারাপ হচ্ছে। ফলে এলাকার মানুষদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বাইরের অনেক বখাটে ও খারাপ মানুষের বিচরণ বেড়েছে। মেয়েরা বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার পথে বখাটের কবলে পড়ছে। ইতিমধ্যে অনেকে অভিভাবক তাদের মেয়েকে ওই বিদ্যালয়ে যেতে দিচ্ছে না।
দাপনাজোর ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. নূরে আলম উজ্জল বলেন, এই রিসোর্টটি যখন শুরু হয় আমরা জানতাম এখানে ভালো কিছু করা হবে। এই কারণে এলাকার মানুষ কিছু বলেনি। কিন্তু যখন দেখলাম এখানে রিসোর্ট তৈরি করে অনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করা হচ্ছে তখন আমরা এটার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু রিসোর্ট মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা কিছুই করতে পারছি না।
মার্থা লিন্ডস্ট্রম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, আগে বাইরের কোন মানুষ আমাদের স্কুলে প্রবেশ করতে পারতো না। কিন্তু স্কুলের সাথে রিসোর্ট হওয়ায় এখন অনেক মানুষ এখানে চলে আসে এবং স্কুলের বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করে। অনেক বখাটে আবার আমাদের বিরক্ত করে। স্কুলের প্রবেশ পথ ও রিসোর্ট এর প্রবেশ পথ একটি হওয়ায় আমাদের চলাচল করতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
রিসোর্টের কারণে বালিকা বিদ্যালয়টি হুমকির মধ্যে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে মার্থা লিন্ডস্ট্রম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মানছুর রহমান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে উত্তর দেন। তিনি জানান অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইছে না।
বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতি টাঙ্গাইল জেলার বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, সরকারি নিয়ম নীতি মেনে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে রিসোর্ট কিংবা হোটেল নির্মাণ করতে হয়। আর কৃষি জমিতে রিসোর্ট কিংবা হোটেল নির্মাণ করা যায় না। যদি কোন ব্যক্তি কৃষি জমিতে রির্সোট নির্মাণ করেন তাহলে তা অবৈধ।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে ওয়াটার গার্ডেন রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের মালিকপক্ষ আমাদের কাছ থেকে কোন প্রকার ছাড়পত্র গ্রহণ করেনি। তারা পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই রিসোর্ট এর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে ওয়াটার গার্ডেন রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের মালিক ড. আহসান মনসুরের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশে আসি আমার এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার জন্য, এলাকার মান উন্নয়নের জন্য। এখানে এসে আমার ব্যক্তিগত সঞ্চয় দিয়ে প্রায় ২৬ কোটি টাকা খরচ করে একটি রিসোর্ট করেছি। এই প্রতিষ্ঠানে আমার এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমি এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি এখানে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানেও আমি আছি। স্কুল ও রিসোর্ট এর যাতায়াত করার রাস্তা একটি হলেও এতে স্কুলের কোন ক্ষতি হচ্ছে না। আর এখানে মোট তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি এনজিও, স্কুল ও রিসোর্ট এ তিনটিই আমাদের। আমরা এলাকার মানুষের ভালোর জন্য এই সকল প্রতিষ্ঠান করেছি।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো: আতাউল গনি বলেন, একটি হোটেল কিংবা রিসোর্ট নির্মাণ করতে সরকারি নিয়মনীতি মেনে করতে হয়। রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারটি বৈধ না অবৈধ তা তদন্ত সাপেক্ষে দেখা হবে।
বাসাইল-সখীপুর আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম বলেন, ওয়াটার গার্ডেন রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারটি যদি নিয়মনীতি না মেনে করে থাকে তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো হবে।
কেএস