উত্তরাঞ্চলে তীব্র দাবদাহে আমন ক্ষেত ফেটে চৌচির

মোহাম্মদ আলী, উত্তরাঞ্চল থেকে প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২২, ০৬:২১ পিএম

কয়েক দিনের টানা খরা ও অনাবৃষ্টি কারণে উত্তরাঞ্চলে দিগন্ত জুড়ে আমন ধানের ফসলের মাঠে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, ফলে কৃষকরা এখন পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না তাই তারা হতাশায় ভুগছেন।

বন্যা পরবর্তী সময়ে উত্তরাঞ্চলে বেশির ভাগ জেলায় অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধানের ফসল পুড়ে গেছে। বৃষ্টির মৌসুম হলেও কাঙ্খিত বৃষ্টির দেখা মেলেনি উত্তরাঞ্চলে। কথায় বলে আষাঢ় আর শ্রাবণ দু মিলে হয় বর্ষাকাল।

সেই আষাঢ় আর শ্রাবণ মাসেও ব্যাঙের নেই কোন ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাং। উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও দেশের একটি কৃষি নির্ভর জেলা।কয়েক দিন আগে আমন চারা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও এখন বৃষ্টির অপেক্ষায় থেকে থেকে দুচিন্তায় আর হতাশায় ভুগছেন কৃষকরা।

কিন্তু বৃষ্টির অভাবে ধান ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এতে করে সমস্যায় পড়েছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। ফলে বেশ কিছু কৃষককে শ্যালোমেশিন, বরেন্দ্র গভীর নলকূপের সাহায্য পানি দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার দানারহাট, বরুণগাঁও, শীবগন্জ নারগুন, বেগুন বাড়ি, খোঁচাবাড়িসহ জেলার পীরগঞ্জ, হরিপুর, রাণীশংকৈল উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে দিগন্তের পর দিগন্ত আমন ধানের ফসলের মাঠে যেন আগুনে জ্বলছে।

ফলে মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে ডিজেলসহ জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা হতাশায় অসহায় হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু স্থানে বিদ্যুৎ চালিত পাম্প ব্যবহার করে সেচ কাজ করার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না থাকায় সেটাও ব্যাহত হচ্ছে।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপগুলি বিদ্যুতের লোডশেডি এর ফলে ঠিক মত চলতে পারছে না ফলে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কৃষকদের।

সদর উপজেলার এক কৃষক জানান, তিনি এক বিঘা জমিতে ধান লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু কিন্তু কয়েকদিন ধরে প্রচন্ড রোদ আর বৃষ্টি না হবার কারণ বৃষ্টির পানি না হওয়াতে আমনের জমিগুলো শুকে যাওয়ায় ওই কৃষক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর এ জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদ হয়েছে ১৮ হাজার ৬৪০ সেক্টর। ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক জানান, অন্যান্য ফসলের ন্যায় ধানের জন্য বিখ্যাত এ জেলায় ব্যাপক পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। প্রত্যেক বছরের ন্যায় এ বছরের কৃষকদের যাবতীয় কৃষি সেবা প্রদান করা হয়েছে।

বৃষ্টির পানির অভাবে একটু সমস্যা হচ্ছে বিশেষ করে উচু জমিগুলোতে একেবারে পানি না থাকায় সম্পূরক সেচ ব্যবস্থা চালু রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আল্লাহর রহমত কৃষকরা আর হয়তোবা হতাশায় ভুগবেন না।

ধানের জন্য বিখ্যাত উত্তরাঞ্চলের জেলা নওগাঁ। সুবৃহৎ এ জেলায় ও এবার অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধান ক্ষেতের ফসল হুমকির মুখে থুবড়ে পড়েছে। অনাবৃষ্টিতে পুড়ছে নওগার নীতপুর পোরসা, নিয়ামতপুর সাপাহার উপজেলার ফসলের মাঠ।

বৃষ্টি না হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে এই জমিগুলো ধুধু সাদা হয়ে পড়ে রয়েছে। পুকুরে সামান্য আরএসএস-এর মাধ্যমে ২০ তলায় বীজ বপন করলেও চারাগুলো হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে।

সাপাহার উপজেলার শাওর তেতুলিয়া, গাংগুরিয়া মিরপুর ও ঘটনপুরের  অনেক গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, উল্লিখিত একই চিত্র। এছাড়াও বৃষ্টির অভাবে অনাবাদি জমিগুলো পড়ে রয়েছে। মুর্শিদপুর ও ঘাটনগর এলাকার কিছু কিছু টিউবয়েল থেকে সেচ কার্যক্রম চালিয়ে ধান রোপন করছেন তারা।

এই এলাকার কৃষকরা প্রতি বিঘা জমিতে ৫ শত থেকে ৬০০ টাকা সেচ খরচের মাধ্যমে ধান লাগাতে পেড়েছে। এছাড়া স্থানীয় কৃষকরা জানান তাদের এলাকায় গভীর নলকূপ না থাকায় বৃষ্টির পানি ও সেচ  সংকটের কারণে আমনের ফসল ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। শ্রাবণ শেষ হয়ে ভাদ্র চলছে তবু দেখা মিলছে বৃষ্টির। ফলে এলাকার কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে বিএমডিএ সংশ্লিস্টরা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যায়ক্রমে সেচ কার্যক্রম চালু করা হচ্ছে। এগুলো দিয়ে চাষিরা তাদের কিছু জমি চাষাবাদ করতে পারবেন।

অপরদিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকার জানান, চলতি আমন মৌসুমী উপজেলায় ১৬ হাজার জমিতে আমান ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে।

তবে অনাবৃষ্টির কারণে লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে আবার নাও হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।তবে বৃষ্টি নির্ভর এলাকায় বৃষ্টি না হলে অমানবৃষ্টির কারণে চাষাবাদ কিছুটা হলেও ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বৃহত্তর পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে রোপা আমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রোপা আমনের চাষাবাদ এর ভরা মৌসুমে কৃষকরা ধানের চারা রোপন করতে পারছেন না।

এদিকে প্রখর রোদে ধানের চারা নষ্ট হয়ে  যাচ্ছে। বর্ষার মৌসুমীতে বৃষ্টি দেখা না পেয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন চাষিরা। ঈশ্বরদী উপজেলার মাঠগুলো ঘুরে এমন চিত্র দেখে গেছে।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কার্যালয় থেকে জানা যায়, চলতি মৌসুমে এখানকার কৃষি বিভাগ মনে করছেন বৃষ্টির পানি ছাড়া আমন ধান উৎপাদন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। কৃষকরা জমিতে সেচের পানি ব্যবহার না করে আমন ধানের ক্ষতি হতে পারে।

এ ব্যাপারে ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার বলেন, আমন মৌসুমে জমিতে বৃষ্টি অত্যন্ত জরুরী কিন্তু বৃষ্টি নেই একদিকে বৃষ্টি নেই অপরদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এ বৈরতায় কৃষকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তার পরেও বেশিরভাগ কৃষকরা সেচের মাধ্যমে জমিতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করে আমন চারা টিকে রাখছেন।

অপরদিকে দিনাজপুরে ও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে ঘোড়াঘাট, বাংলা হিলি হাকিম পুর, ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর সদরসহ বেশিরভাগ এলাকায় অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধানের ফসলের মাঠ ফেটে গেছে।

শ্রাবণ মাসে অতিবাহিত হয়ে ভাদ্র মাস চলছে বৃষ্টি না হওয়ায় কোন উপায় না পেয়ে অবশেষে শুকনা জমিতে মেশিন দিয়ে পানি শেষের ব্যবস্থা করে টিকে রাখছেন কৃষকরা।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ শস্য ভান্ডার উপজেলা। এই উপজেলায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপন করে থাকেন কৃষকরা। কিন্তু তীব্র তাপদাহের কারণে সঠিক সময়ে জমির তৈরি করেও পানির অভাবে ফসল টিকে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কৃষকরা শুকনা ও ফাটা জমিতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।

শ্রাবণ ও ভদ্র মাস বৃষ্টি না হবার কারণে  হতাশ হচ্ছেন কৃষকরা। কিচক ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের কৃষক শাহআলম আব্দুর নূর, আবু সাঈদ বলেন, আমাদের জীবনে এমন আবহাওয়া কখনো দেখিনি। বৃষ্টি না হওয়ার ফলে আমরা আমন রক্ষা করতে পারছি না রোদে পুড়ে লাল বর্ণ ধারণ করে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা আরো বলেন, সঠিক সময়ে জমি তৈরি করা হয়নি তারপরও আবার অনাবৃষ্টি কারণে আমন ধানের ফসলের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে এমন ধারণা করছেন।

এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মুজাহিদ সরকার বলেন, এ উপজেলা কৃষি বিপ্লব এলাকা, সময়মতো বৃষ্টি না হলে আমন ধানের ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, তাপমাত্রার বেশি থাকলে সমস্যা বেশি হতে পারে দেরি করে এমন ধান রোপন করলে ধান গাছে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি হতে পারে। ভারতবর্ষেও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নদ নদী কাল বিল পানি শুকিয়ে গেছে। বর্ষার পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে যারা  আমন ধানের জমি চাষাবাদ করেছেন তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন।

তারা কোথাও পানি পাচ্ছেন না এতে আগাম লাগানো ধানের ক্ষেতগুলো পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন।এবং সেই সঙ্গে কৃষি বিভাগের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে চলতি মৌসুমে।পানি না থাকায়  ধানের জমি ফেটে গেছে।

এ ব্যাপারে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ দুলাল হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এ জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৯শত পঞ্চাশ হেক্টর। বগুড়ার ১২ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনাবৃষ্টি আর খরার প্রভাবে শ্যালো মেশিন,বিদ্যুৎ চালিত পাম্প ব্যবহার এবং বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপের সাহায্য আমনের ফসলে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, বৃষ্টি আল্লাহর রহমত বৃষ্টি হলে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, কৃষকদের দুচিন্তার কারণ নেই।

জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, এ জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৭০০ হেক্টর। তিনি আরো জানান, জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল, আক্কেলপুর, পাঁচবিবি ও সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় অনাবৃষ্টির কারণে সাময়িক সমস্যা হলেও পরবর্তীতে হালকা বৃষ্টিপাতের ফলে পাঁচবিবি উপজেলাসহ  কিছু এলাকায় আমন ধানের ফসলের মাঠ স্বাভাবিক হয়ে গেছে, তবে বৃষ্টি আল্লাহ তাআলার বিশেষ নিয়ামত, এখন পর্যন্ত আমন ধানের ফসলের মাঠ কিছুটা হলেও ভালো আছে বৃষ্টি হলে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। এ ব্যাপারে কৃষকদের হতাশা হবার কারণ নেই বলে মনে করছেন।

কেএস