শেবাচিমে চিকিৎসকরা স্লিপ দিয়ে পাঠান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে!

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ০২:৩৯ পিএম

*পুরো হাসপাতাল জুড়ে চলছে চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য
*চিকিৎসকদের কাছে অসহায় রোগীরা 
*ভ্রাম্যমাণ আদালত উদ্ধার করেছে ডাক্তারের দেয়া স্বাক্ষর ও সিলসহ স্লিপ

দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালের বাইরের নাম সর্বস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে কমিশন বাণিজ্য করছেন চিকিৎসকরা।

এ অভিযোগ বহুদিনের। কমিশনের ভাগাভাগি নিয়ে চিকিৎসককে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে হাসপাতালে। অসুস্থ মানুষকে জিম্মি করে চলা এ বাণিজ্য নিয়ে মুখ খুলতো না কেউ। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় ভয়ে মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য করে নিতেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

তবে এবার তা হাতেনাতে ধরা পড়ছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে। হাসপাতালের সামনের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসা এক রোগীর কাছে পাওয়া গেছে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের সিল ও স্বাক্ষর দেয়া স্লিপে। ওই রোগীকে চিকিৎসক স্পষ্ট বলে দিয়েছেন কোন ডায়াগনস্টি সেন্টারে যেতে হবে। রোগীর মুখ থেকে বিষয়টি শুনে অনেকটা হতবাক হয়ে যান ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা কর্মকর্তারা।

তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে অভিযানে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কঠোর নির্দেশনা অনুযায়ী গত মঙ্গলবার থেকে বরিশালে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান শুরু করা হয়েছে। অভিযানে নেতৃৃত্ব দিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ হুমায়ুন খান শাহিন। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসানও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সূত্রমতে, শেবাচিম হাসপাতালের সামনে থাকা ‘বরিশাল সিটি সেন্টার’ নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান রোগীর কাছ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত শেবাচিম হাসপাতালের স্লিপ উদ্ধার করেন। সেই স্লিপে রয়েছে কর্তব্যরত ডাক্তারের দেয়া স্বাক্ষর ও সিল।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে ওই রোগী বলেন, মাথায় আঘাত পেয়ে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন সিটি স্ক্যান করাতে হবে। কোথায় করাতে হবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে স্লিপে স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে চিকিৎসক তাকে ওই সেন্টারে পাঠিয়েছেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু রিয়াদ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।

অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ হুমায়ুন খান শাহিন বলেন, বরিশাল সিটি সেন্টার নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স ‘সি’ ক্যাটাগরির। অথচ তারা মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে সিটিস্ক্যান করছিল।

তিনি আরও বলেন, সিটিস্ক্যান মেশিন বসানোর ক্ষেত্রে লাইসেন্স এ ক্যাটাগরির হতে হয়। অনিয়ম ধরা পড়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এ রকম রোগী পেয়েছি, যারা চিকিৎসার জন্য শেবাচিমে ভর্তি আছেন। কর্তব্যরত ডাক্তার নিজে স্লিপে সিল ও স্বাক্ষর করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীকে ওই সেন্টারে পাঠিয়েছেন, যা একটি অপরাধ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রথম চিকিৎসা দিয়ে থাকেন ইন্টার্ন ডাক্তাররা। পরীক্ষার নামে বাণিজ্য শুরু হয় এখান থেকেই। সিনিয়র ডাক্তাররা পরীক্ষা দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এদের সিস্টেম হচ্ছে- রোগী যেখানেই পরীক্ষা করাক না কেন কমিশনের টাকা সময়মতো পৌঁছে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এ বাণিজ্য নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে এখানে অন্তর্দ্ব›দ্ব-কোন্দলের ঘটনাও ঘটে অহরহ।

সমপ্রতি হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট-৪ এর সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ মোঃ মাসুদ খানকে অফিস কক্ষে আটকে মারধর করেন ৪৬ ব্যাচের সজল পান্ডে, তরিকুল এবং ৪৭ ব্যাচের রিজভীসহ তাদের সহযোগীরা। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতাল থেকে বেসরকারী ডায়াগনস্টি সেন্টারে রোগী পাঠানোর কমিশন নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে ওই হামলা হয়েছে।

এছাড়াও গত বছর ‘শেবাচিম হাসপাতালে অপারেশন করালে রোগী মারা যাবে’ এমন ভয় দেখিয়ে বেসরকারী ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করানোর অভিযোগ ওঠে শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ একেএম মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে।

রোগীর স্বজনের দেয়া লিখিত অভিযোগের পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও পরবর্তীতে কমিটির রির্পোটে কি হয়েছে, তা কেউ জানেন না। রোগীকে ভয় দেখিয়ে বেসরকারী ক্লিনিকে নেয়াই শুধু নয়; হাসপাতালে থাকাবস্থায় যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে বাধ্য করারও অভিযোগ আনা হয় ডাঃ মিজানের বিরুদ্ধে।

শেবাচিম এবং বরিশাল সদর হাসপাতালের সামনের একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা বলেন, ব্যবসা করতে হলে ডাক্তার সাহেবদের কমিশন দিয়েই করতে হয়। একটা সময় ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মোট বিলের শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ টাকা কমিশন দিতাম। এখন ৩০ থেকে ৪০ ভাগ দিতে হয়।

শুধু কমিশনই নয়; ডাক্তারদের নানা আয়োজন যেমন পিকনিক, ডিপার্টমেন্টের উৎসবসহ নানা ওকেশনে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে পরের দিন থেকে রোগী আসে না।

ডাক্তারের সিল ও স্বাক্ষরসহ স্লিপ ধরা পড়ার বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, এটা যদি কেউ করে থাকেন তা অপরাধ।

এই বিষয়ে বেশ কয়েকবার নোটিস এবং সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া হাসপাতালের পরীক্ষাগারগুলো এখন দুই শিফটে চলছে। যে সব পরীক্ষা এখানে হয় না সেগুলো বাইরে করা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সিল ও স্বাক্ষর দিয়ে স্লিপ দেয়া যাবে না। এ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে তার (চিকিৎসক) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।


এআই