আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব নির্দেশনার মধ্যে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর প্রিসাইডিং অফিসারকে অবহিত করে তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণ করতে পারবেন সাংবাদিকরা। তবে ভোটকেন্দ্রে ১০ মিনিটের বেশি অবস্থান করা যাবে না বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সেইসাথে সংবাদ সংগ্রহের কাজে সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের জন্য কোনো স্টিকার ইস্যু করা হবে না বলে জানিয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে ১৩টি নির্দেশনার মধ্যে কয়েকটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন সাংবাদিক নেতারা।
এমন কড়াকড়ি নির্দেশনার মাধ্যমে গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকাকে আড়াল করে রাখার চেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেক প্রার্থী। তাদের আশঙ্কা গণমাধ্যমের ওপর এমন হস্তক্ষেপের সুযোগ নিতে পারে অশুভশক্তি। নির্বাচন কমিশনের দাবি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ সাংবাদিকরা নির্বিঘ্নে যেন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন, সেজন্য কিছু বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে।
রসিক নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহে যে ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো-(১)নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বৈধ কার্ডধারী সাংবাদিক সরাসরি ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর প্রিসাইডিং অফিসারকে অবহিত করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণ করতে পারবেন। তবে কোনোভাবেই গোপন কক্ষের ছবি সংগ্রহ কিংবা ধারণ করতে পারবেন না। (২) একই সঙ্গে একাধিক মিডিয়ার সাংবাদিক একই ভোট কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং ১০ মিনিটের বেশি ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবেন না। (৩) ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্ট বা ভোটারদের সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না। (৪) ভোটকক্ষের ভেতর থেকে লাইভ স¤প্রচার করা যাবে না। (৫) ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে সরাসরি স¤প্রচার করতে হলে ভোটকক্ষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে তা করতে হবে, কোনোক্রমেই ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। (৬) সাংবাদিকরা ভোট গণনা কক্ষে ভোট গণনা দেখতে পারবেন, তবে সরাসরি স¤প্রচার করতে পারবেন না। (৭) ভোটকক্ষ থেকে ফেসবুকসহ কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সমপ্রচার করা যাবে না। (৮) কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম ব্যাহত হয় এমন সব ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। (৯) ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকরা প্রিসাইডিং অফিসারের আইনানুগ নির্দেশ মেনে চলবেন। (১০) নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। (১১) কোনো প্রকার নির্বাচনী উপকরণ স্পর্শ বা অপসারণ করতে পারবেন না। (১২) নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের সময় প্রার্থী বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোনো ধরনের প্রচারণা বা বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে বিরত থাকবেন। (১৩) নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার জন্য নির্বাচনী আইন ও বিধি মেনে চলবেন।
উল্লিখিত নির্দেশনা পালন না করলে বা তার ব্যত্যয় ঘটালে নির্বাচনী আইন, বিধি ও কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ও যুগ্মসচিব এস এম আসাদুজ্জামান। রংপুর সিটি কর্পোরেশন সাধারণ নির্বাচন-২০২২ উপলক্ষে সাংবাদিকতা বিষয়ক নীতিমালা সংক্রান্ত একটি পরিপত্র গত ১৮ ডিসেম্বর জারি করা হয়েছে। এ পরিপত্রটি রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেনকে পাঠিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ও যুগ্মসচিব এস এম আসাদুজ্জামান।
এদিকে সংবাদ সংগ্রহে নির্বাচন কমিশনের এই নীতিমালা বা নির্দেশনার কয়েকটি বিষয় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। কেউ কেউ এ ধরনের কড়াকড়ি নির্দেশনাকে কালাকানুন হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
রিপোর্টাস ক্লাব রংপুর এর সাধারণ সম্পাদক বলেন, গণমাধ্যমের যে মূখ্য ভূমিকা সেটি একেবারেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একজন গণমাধ্যম কর্মী চাইলেও নীতি নৈতিকতার মধ্যে থেকে কাজ করতে পারবেন না। মোটা দাগে বলা যায় এটি সাংবাদিকতায় এক ধরনের শক্ত বাধা।
বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহুল মোকাররবিন হিমেল বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে ১০ মিনিটের বেশি ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করা যাবে না। এ ধরনের নির্দেশনা এর আগে অন্য কোনো নির্বাচনে কখনো শুনিনি। আর এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশন থেকে সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারে স্টিকার দেওয়া হচ্ছে না। আমরা যারা সংবাদ সংগ্রহের কাজে মোটরসাইকেল ব্যবহার করি, তারা কিভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে, এটাও তো ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
রংপুর প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী বলেন, এ ধরনের কালাকানুন নীতিমালার নিন্দা জানাচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের এসব নির্দেশনা স্বাধীন সাংবাদিকতায় এক ধরনের বাধা। এবার সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না, এটা দুঃখজনক। এছাড়া পিআইডির এক্রিডিটেশন কার্ড না থাকায় অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংবাদকর্মীদের নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের জন্য কার্ডও দিচ্ছে না কমিশন। আমি রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নাকি কিছুই করতে পারবেন না।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আবদুল বাতেন বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভোটগ্রহণের দিনসহ বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকরা যাতে নির্বিঘ্নে নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন, সেজন্য সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা অবশ্যই নির্বাচনের সময়, ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনার সময় প্রযোজ্য বিধি-নিষেধ মেনে করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত ব্যক্তি ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন। এজন্য ভোটকেন্দ্রের সংবাদ সংগ্রহের জন্য নির্বাচন কমিশন হতে সাংবাদিকদের কার্ড সরবরাহ করা হবে।
প্রসঙ্গত, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রংপুর সিটিতে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এতে ২ লাখ ১২ হাজার ৩শ’ ২ জন পুরুষ এবং ২ লাখ ১৪ হাজার ১শ’ ৬৭ জন নারী ভোটার ২শ’ ২৯টি কেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। এবার মেয়র পদে ৯ জনসহ সংরক্ষিত ১১টি ওয়ার্ডে ৬৮ এবং ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১শ’ ৮৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এআই