ছোট বয়সে বড় দায়িত্ব

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৩, ০১:২৫ পিএম

যেদিন বেশি বিক্রি হয় সেদিন দুপুরে ৩০ টাকা দিয়ে পেট ভরে ভাত খাই, নইলে রুটি বা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেই’ ---শাহাআলম

যে বয়সে বই নিয়ে বিদ্যালয়ে ছুটোছুটি করার কথা সে বয়সে স্টেশন থেকে স্টেশন তিলের খাজা বিক্রি করা শাহাআলম সংসারের রোজগারের অন্যতম উৎস সে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়িও হয়নি শাহাআলমের।

বিদ্যালয়ের বারান্দা, বেঞ্চ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি, খুনসুটির দেখা মিলেনি তার ছেলেবেলায়। শিক্ষার আলো ছুঁতে পারেনি শাহাআলমকে। তবে একমাত্র ছোট ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নবুনে দিনের পর দিন স্টেশন থেকে স্টেশনে ব্যস্ত সময় পার করছেন ১২ বছরের শাহাআলম।

দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও, অপেক্ষা কখন ট্রেন আসবে। দিনাজপুর থেকে ট্রেনে করে ঠাকুরগাঁও স্টেশনে। আবার কখনো দিনাজপুরগামী ট্রেনের অপেক্ষা। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশন ছাড়া কখনো কোথাও অনুষ্ঠান বা খেলা হলে চলে যায় সেখানে। ফেরি করে বিক্রি করেন তিলের খাজা।

দৈনিক যা বিক্রি করেন তা দিয়েই চলে সংসার। জীবিকার তাগিদে স্টেশন থেকে স্টেশনে ফেরি করে সংসারের হাল টানছেন শাহাআলম। তবুও নিরাস হননি, বেছে নেননি ভিক্ষাবৃত্তির পথ।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মন্দির পাড়া এলাকার শফিকুল ইসলাম ও সাবিনা বেগম দম্পতির ছেলে  শাহাআলম (১২) ও ছোট ছেলে শাহজালাল (৯)। শাহাআলমের পিতা মারা যান একবছর বয়সে। চার বছরে মা সাবিনা বেগমের বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। বাধ্য হয়েই রেলস্টেশনে তিলের খাজা বিক্রি করেন তিনি। একমাত্র ছোট ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন তার।

ছোট্ট শাহাআলম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, একবছর বয়সেই অসুস্থতায় চিকিৎসা না পেয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন বাবা শফিকুল ইসলাম। চার বছরের মাথায় মা সাবিনা বেগম অন্য একজনকে বিয়ে করে শুরু করেন সংসার। রয়ে গেলাম আমরা দুই ভাই। ছোট ভাই আর আমাকে দেখার কেউ নেই।

  • সারাদিন রেলস্টেশনে  তিলের খাজা বিক্রি করেন শাহাআলম
  • ছোট ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছেন 
  • বাবার মৃত্যু হয় একবছর বয়সে, চারবছর বয়সে মায়েরও বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র

শাহাআলমের দাদার বাড়ি সদর উপজেলার শিবগঞ্জ বাজারে দুধ হাঁটিতে। সেখানেও চাচাদের সাড়া না পেয়ে চলে আসি নানির কাছে। নানি রাস্তার কাজ করে যতটুকু উপার্জন করে তাতে পরিবার চলতে হিমশিম খেতে হয়৷ তাই বাঁধ্য হয়ে নিজেই নেমে পড়ি স্টেশন থেকে স্টেশন তিলের খাজা বিক্রি করতে।

প্রতিদিন সকাল ৭ টায় স্টেশনে আসি ৪০০ টাকার আড়াই কেজি তিলের খাজা নিয়ে। তা বিক্রি করি ৬৫০ টাকা। কোনো দিন সব বিক্রি হলেও কোনো কোনো দিন ফিরিয়ে নিতে হয়। সারাদিন ঠাকুরগাঁও থেকে দিনাজপুর এবং দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও লোকাল ট্রেনে এবং স্টেশনেই বিক্রি শেষে বিকেল ৫ টায় বাড়ি ফিরে আসি। 
যেদিন বেশি বিক্রি হয় সেদিন ৩০ টাকা দিয়ে পেট ভরে দুপুরে ভাত খাই, নইলে রুটি বা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেই। আমি পড়াশোনা করতে পরিনি, আমার ইচ্ছে ছোট ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। এখন ছোট ভাই শাহজালালকে একটি প্রাইভেট স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেছি। মাসে ৫০০ টাকা বেতনে দিতে হয়। পড়াশোনার সম্পূর্ণ খরচ আমিই চালাই। 
জাতিসংঘ প্রণিত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কমবয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়। বাংলাদেশের শ্রম আইনে (২০০৬) ১৪ বছরের কমবয়সী কাউকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার না কারার নির্দেশ দেয়া আছে। এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসারে, যখন কোনো শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে; তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে শিশুশ্রমকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এ কাজকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এসব আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোথাও। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক জায়গায় শিশুদের নামমাত্র মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবুঝ, অল্পেতুষ্ট ও বাধ্য হয়ে কাজে আসার সুযোগে অনেক সময় শিশুদের খাটিয়ে নিচ্ছে মুনাফালোভীরা। তবে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে দেশে দৃশ্যমান তেমন কোনো শাস্তিও দেখা যায় না।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে প্রাথমিক শিক্ষাআইন পাশ করা হয়। এমনকি বিনামূল্যে এ শিক্ষা গ্রহণের পাশপাশি বৃত্তিমূলক ব্যবস্থাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করতে সরকারের এত উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত এমন কাজ চলছে। অথচ এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট কারোই।
পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় অনেক শিশুই কাজ করে। তবে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ ও বৈধদের সার্বিক তথ্য হালনাগাদকরণে কাজ চলছে। যদি বৈধ কোনো দোকানে কর্মরত কোনো শিশুকে বঞ্চিত করার প্রমাণ মেলে, তবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এআরএস