বরিশালে ইট ভাটায় উজাড় ফসলি জমি

বরিশাল ব্যুরো প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩, ০৬:৩৫ পিএম

ইটভাটায় শুধু গাছ নয়, এবার খালপাড়ের জমির মাটি কেটে নিয়ে তা নদী আকৃতি পেয়েছে বেশিরভাগ গ্রামে। অন্যদিকে উজাড় হচ্ছে ফসলি জমি। কৃষকের জমির মাটি কেটে বদলী জমি নিতে বাধ্য করার অভিযোগ অনেক ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ নিয়ে গেলে মালিক পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের কেনা জমিতে আমরা মাটি কাটছি’। অন্যের জমিতে তো যাইনি। আর এভাবে ফসলি জমি উজাড় হতে দেখেও নিরবতা পালন করছে বরিশালের পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসন।

সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে বরিশালের সদর উপজেলার ঘোপের হাট, চরকরঞ্জী, রাণীরহাটসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যেসব এলাকায় ইটভাটা হচ্ছে তার আশপাশে ফলজ বৃক্ষের ফলদান ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে গাছ। আর এইসব ইটভাটার বেশিরভাগই অবৈধ বলে দাবি পরিবেশবিদদের। এমন চিত্র বরিশালের আনাচে-কানাচে অসংখ্য ইটভাটায়। চরকরঞ্জী ও কর্ণকাঠী গ্রামের ভিতরে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় পাশাপাশি দুইটি ইটভাটা নষ্ট করছে সামাজিক পরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। হেরিংবোন ও মাটির সড়কে মাটি বোঝাই ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক। গ্রামবাসী প্রতিবাদ বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেই তেড়ে আসছে মাস্তান বাহিনী। তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ফলে বন্ধ সব অভিযোগ ও প্রতিবাদ এখন। এমনটাই জানালেন বরিশাল সদরের চরকাউয়া ইউনিয়নের পূর্ব কর্ণকাঠী গ্রামের বাসিন্দারা।

এখানে ইটভাটা দুটোর মালিক মিলন হাজী ও সজিব মৃধাসহ আরো কয়েকজন। একই অভিযোগ জানান চরকরঞ্জী থেকে ঘোপের হাট ও তালুকদার হাট এলাকার বাসিন্দারা। তালুকদার হাট থেকে ঘোপের হাট হয়ে বৈরাগবাড়ি সড়কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে আছে এখানের একটি ইটভাটার মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায়। কারণ, মূল রাস্তার নকশা রয়েছে রচি ব্রিক ফিল্ডের ভিতর দিয়ে। সাইফুল ইসলাম দুলাল হাওলাদার নামের প্রভাবশালী নেতা এই ব্রিক ফিল্ড এর মালিক।

শুধু তাই নয়, এখানে খাল পার সংলগ্ন সব জমি তার দখলে। ইটভাটার জন্য মাটি কেটে কয়েকটি স্থানে খালের আকৃতি বদলে দিয়েছেন তিনি। বৈধ না অবৈধ ইটভাটা এগুলো জানে না গ্রামবাসী।

তবে ২০১৯ সালে সংসদে পাসকৃত বাংলাদেশ সরকার ইটভাটার জন্য যে নীতিমালা প্রনয়ন করেছে তা মানা হচ্ছে কিনা সেটাও তদারকি হয়না বলে অভিযোগ অনেকের। নীতিমালায় বলা হয়েছে ‘প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দীঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটিতে বা সংগ্রহ করিতে পারিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, ইটভাটার লাইসেন্সের জন্য আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত ইটভাটার মালিক কর্তৃক ইট প্রস্তুতের মাটির উৎস উল্লেখপূর্বক হলফনামা দাখিল করিতে হইবে’। উপধারা (৩) এ পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে – ‘ইটের কাঁচামাল হিসেবে মাটির ব্যবহার হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের একটি নির্দিষ্ট হারে ছিদ্রযুক্ত ইট ও ব্লক প্রস্তুতের জন্য নির্দেশনা জারি করিতে পারিবে।’

কিন্তু বরিশালের চরকাউয়া, চাঁদপুরা, চরামদ্দি, সঠিখোলাতে খালের পাড়ে আবাদি জমিতে গড়ে ওঠা পাঁচ/ছয়টি ইটভাটা খালপাড় থেকেই মাটি কেটে নিচ্ছে। আর এসব ইটভাটাগুলোতে পুড়ছে কাঠ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশালের ১০ উপজেলার ১৫৭টি ইটভাটার মধ্যে ৬৩টির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ২৮টি জিগজ্যাগ কিলন পদ্ধতির চিমনির ইটভাটা বাদে বাকি সবগুলোতেই অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কয়লা ব্যবহার করছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের কয়লা। সেটাও আবার ব্যবহার না করে সাজিয়ে রাখা হয় দীর্ঘদিন। এটা জেনেও না জানার ভান করছে প্রশাসন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে জেলার ইটভাটাগুলোতে ১১ লাখ ৮০ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এ হিসাব পরিবেশ দপ্তরে থাকার পরও ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়েনা কখনোই। সম্প্রতি ঢাকার এক সংবাদ সম্মেলনে ইটভাটা নিয়েই ছিলো প্রধান আলোচনা। সেখানে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, সারাদেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ ইটভাটা বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর বাকি ৪৪ শতাংশ ইটভাটা অবৈধ। এসব ইটভাটা বিগত বছরগুলোর মতো চলতি মৌসুমেও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জীব বৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান।

আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত বৈধভাবে আমদানি করা কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের ও উচ্চ সালফার যুক্ত। এই সালফার মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইট পোড়াতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করায় সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক বায়ুদূষণ।

প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান তার সার্বিক পর্যালোচনায় বলেন, ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। দেশে গাছ লাগানো আজ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা তার কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছি না। এর অন্যতম প্রধান কারণ ইটভাটায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো হয়। আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, নির্ধারিত মাত্রার সালফার যুক্ত কয়লা ব্যবহার, জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ইটভাটা সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নে ভাটার মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বরিশালের চিত্র তুলে ধরে পরিবেশ, বন ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট সবাই এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও বলেন, দেখছি। এখনই ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে।

কেএস