বন সংলগ্ন ইটভাটা, তাও আবার নিবন্ধন বিহীন। নিয়ম না মেনে বন ও ফসলি জমির মাঝখানে ইট-ভাটা স্থাপন করে একদিকে যেমন বনের কাঠ পুড়িয়ে পরিবেশের চরম ক্ষতি করছেন অপরদিকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলছে উপজেলার আড়াই লক্ষাধিক মানুষ। জিগজ্যাগ সনাতনি পদ্ধতিতে স্থাপন করা এসব ইট-ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। কিন্তু লোক দেখানো কিছু কয়লা ভাটার পাশে রাখা হলেও এর আড়ালে ইট পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ দিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলায় ৩২টি অবৈধ ইটভাটা চলতি মৌসুমে ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর বিপুল আয়োজন করা হয়েছে, যা আইনত নিষিদ্ধ। ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনায় সরকারি নির্দেশনা মানছেন না বেশির ভাগ ইট-ভাটার মালিক। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র ও ঘাটাইল ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্যমতে ঘাটাইলে নিবন্ধনবিহীন ইট-ভাটার সংখ্যা ৩২ টি। এসব ভাটায় প্রকাশ্যে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটা মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যমতে উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা ৪৫ টি। এর মধ্যে নিবন্ধন রয়েছে মাত্র ১৩ টির। অবৈধের তালিকায় ৩২টি। আবার অধিকাংশ ভাটার নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০১৩) অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও আবাদি জমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন এবং ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কোন কোন এলাকায় আবাদি জমির মাঝখানে ইটভাটা নির্মাণে আইনের কোন তোয়াক্কা করা হয়নি। পরিবেশ অধিদফতর থেকে কোনো ছাড়পত্রও নেয়া হয়নি বলেও জানা গেছে। ইটভাটার আশপাশে ফসলি জমিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফসল আবাদ। ইট-ভাটার কালো ধোঁয়ায় বাতাসে বেড়েই চলেছে বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস,সেই সাথে ধুলাবালির কারণে এসব ক্ষেতের ফসল উৎপাদনে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। দিনরাত ধরে মাটি ও ইট আনা নেওয়া করায় গ্রামের রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে। ধলাপাড়া পেচার-আটা মোড় থেকে রসুলপুর আমতলা পর্যন্ত পাঁকাসড়কের দু,পাশেই রয়েছে প্রায় ডজন খানেক ইটভাটা।
এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারি পথচারি মো. শাহজাহান মিয়া জানালেন, ইটভাটার কারনে ভালো সড়কটি অল্পদিনেই শেষ। মাটি কাটা হাইট্রলির বেপরোয়া গতিতে প্রায়ই ঘটে দূর্ঘটনা।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-তে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি ব্যবহার করলে তার শাস্তি দু`বছর কারাদন্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা। ওই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তি ২-১০ বছরের জেল এবং ২-১০ লাখ টাকা জরিমানা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধলাপাড়া এলাকার সোনার বাংলা, বংশাই, ভাই ভাই ও আশিক ব্রিকস, রসুলপুর এলাকার সোনালী, সততা, আকাশ, তিতাস,সাগর ও যমুনা ব্রিকস, দেউলাবাড়ি এলাকার এমএসএম ও আরএসএম, আনেহলা এলাকার মিশাল ও সিয়াম ব্রিকস, আন্দিপুর এলাকার কেআরবি, লোকেরপাড়ার কনক ও দেওপাড়া এলাকার এমআরটি ব্রিকস প্রকাশ্যে কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে। একদিকে জ্বালানী কয়লার দামবৃদ্ধি, অপরদিকে ভাটাগুলো বনের আশেপাশে হওয়ায় সহজেই মিলছে কাঠ। ইট-ভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি মেট্রিকটন কয়লার দাম ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অপরদিকে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মেট্রিকটনকাঠ।
ইটভাটা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতি ভাটায় ইট পোড়াতে দিন-রাতে সাত থেকে প্রায় আট মেট্রিকটন কাঠের প্রয়োজন হয়। এসব কাঠের জোগান অধিকাংশই আসে বন থেকে। ইট-ভাটাগুলোর নিকটতম লাকড়ীর বাজার ঘাটাইল- মধুপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গারোবাজার। অথচ আইন অনুযায়ি জ্বালানি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপরও অবাধে চলছে এ কাজ। ঘাটাইলে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। মূলত পাহাড়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বন। এখানে রয়েছে সামাজিক ও সংরক্ষিত বনের প্রচুর পাহাড়ি বনজ ও ঔষধি গাছ। পাহাড়ি এলাকার মানুষ জানায়, প্রতিরাতেই ট্রাক ভরে বনের কাঠ যায় ইটের ভাটায়।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার দিনের বেলায়ই দেখা যায় সোনালী ব্রিকসে কাঠ খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রাক। শ্রমিকরা ইট তৈরিতে ব্যস্ত, ইট তৈরিতে হিউমাস সমৃদ্ধ আঠালো মাটি উত্তম হওয়ায় ফসলি জমির টপ-সয়েল চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এলাকাবাসীর শঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে বন ও মাটির উর্বর শক্তি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো ভাটার মালিকগণ কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো অধিকাংশ ভাটার দূরত্ব বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জ অফিস থেকে এক কিলোমিটারও হবেনা। তবুও কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে অবগত নন বলে জানান রেঞ্জ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম। উল্টো তাঁর প্রশ্ন , আইনে আছে বনের দুই কিলোমিটারের ভেতর ইটভাটা স্থাপন করা যাবেনা। কিভাবে গড়ে উঠল এসবভাটা? তবে কোনো ভাটায় কাঠ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
পরিবেশবাদী গবেষক সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন একেবারে নিষিদ্ধ। জেলার অনেক ইট-ভাটা স্থাপনে সে নিয়ম মানা হয়নি। অনেক ভাটায় কয়লার বদলে ইট পোড়ানো হয় কাঠ দিয়ে।ঘাটাইলে এর পরিমাণ বেশি। এতে চাপ পড়ছে বনাঞ্চলের ওপর। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হলেও ভাটার মালিকরা তা মানছেন না।
টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মিনহাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, নিয়ম না মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আশপাশের বসতি এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। ইট-ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় তাঁরা চোখ, ত্বক ও ফুসফুসের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে ইটভাটায় আগুন লাগানোর জন্য কাঠ পোড়ানো হয়। এগুলো দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।
টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ইটভাটায় কয়লার ব্যবহার করতে হবে। কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অবৈধ ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হলে অভিযান চালিয়ে থাকি। গত বছর ৬৭টি ইটভাটাকে এক কোটি ৭১ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। এবারও নিয়ম মানা না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে উপপরিচালক বলেন, আমাদের জনবল সংকট এবং এলাকা বড়।
আরএস