ছোটবেলা থেকে আব্বুর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনেক গল্প শুনেছি। তিনি টানা ৭২ ঘন্টাও সাইকেল চালিয়েছেন। আব্বুর এমন গল্পগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে লেখাপড়া করি, তখন থেকেই আমার একমাত্র বাহন সাইকেল। আমার ইচ্ছে হতো আমি সাইকেল নিয়ে দূরদুরান্তে হারিয়ে যাই।
ছোট বেলা থেকে সাইকেল নিয়ে আমার পাগলামি শুরু। একবার পাগলামি এমন পর্যায়ে চলে এসেছিলো যে আমাকে আমার পরিবার মাদকসক্ত মনে করে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে আসে। তবুও আমি দমে যাইনি। সাইকেল চালিয়েছি। শুধু আমার দেশেই নয় প¦ার্শবতী দেশ ভারতে সীমান্ত জেলাগুলো ঘুরেছি। দেখেছি তাদের বৈচিত্রময় জীবন । এভাবে সাইকেলে চড়েছি প্রায় এক লাখ কিলোমিটার। আমার স্বপ্ন সাইকেলে বিশ^ ভ্রমণ করা।
সাইকেল ভ্রমন নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এভাবেই অনুভুতি ব্যক্ত করেন মাহমুদুল হাসান ইফাজ। ইফাজ কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া গ্রামের সন্তান। তার বাবা গোলাম মোস্তফা একটি হজ¦ ট্রাভেল এজেন্সির গাইড হিসেবে নিয়োজিত আছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইফাজ ছোট। বড় ভাই ইথার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সময় দেন। হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করা ইফাজের সব স্বপ্ন সাইক্লিং নিয়ে।
ইফাজের বর্ণনায় উঠে আসে তার সাইক্লিং জীবনের কথা। প্রায় এক লক্ষ কিলোমিটার সাইকেলে চড়েছেন। জিপিএস ট্রাকিং এপ স্ট্রাভাতে রেকর্ড আছে ৬২ হাজার কিঃমি সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর তথ্য। বাকি তথ্যগুলো গুগল ড্রাইভে সেভ করে রেখেছেন। সাইকেলের এমন নেশায় ভয়ংকর সব কাজ করেছেন ইফাজ। সেগুলো বর্ণনা ছিলো লোমহর্ষক।
২০১৪ সালের ঘটনা। ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি সাইকেল র্যালী হবে। এমন তথ্য শুনেই ইফাজ রওনা করলেন একটি ফনিক্স সাইকেল নিয়ে। তার ভিসা পাসপোর্ট নেই। তবুও সে ওই র্যালীতে অংশগ্রণ করবেন। বাড়ি থেকে টানা দুই দিন সাইকেলে চড়ে বেনাপোল বন্দরে উপস্থিত হন। তবে পাসপোর্ট ভিসা না থাকায় বন্দর দিয়ে ওপাড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সাইকেল কাঁধে নিয়ে নদী সাতরে ভারতে যান। তবে নদীর চরে ডাকাতের কবলে পড়েন। সে সময় বহু কষ্টে রক্ষা পান।
ভারতে সাইকেল র্যালী যারা আয়োজন করেছেন তারা ইফাজের মুখে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা ভ্রমনের গল্প শুনে খুবই অবাক হন। একটা ছেলের সাইকেল নিয়ে এমন প্যাশন আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। সেবার ইফাজ ভালো ভাবে সাইকেল র্যালী সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে আসেন।
সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে বহুদিন বাড়িতে না ফেরার ঘটনাও ঘটেছে। বাবা মায়ের বকুনি শুনতে হয়। এখনো এমনই ঘটে। তবে ইফাজের এ নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সাইক্লিংয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন।
গেল মাসেই ইফাজের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। মন খারাপ হয় ইফাজের। বেশ কিছু দিন পায়ে হেটে বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করেন। সাইকেল চুরির ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অনেকে জেনে ইফাজকে সান্তনা দেন। পরে সাইক্লিস্টদের চোরকে সনাক্ত করে সাইকেলটি উদ্ধার করতে সমর্থ হন। সাইকেল নিয়ে ইফাজের এমন বহু ঘটনা আছে। সেসব বাদে ইফাজ বড় করে দেখেন তার সাইকেল নিয়ে চড়ে বেড়ানোর কথা।
ইফাজ জানান, একদিনে তিনি টিম বিডিসির সাথে বিরতিহীন ৫০০ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমন করেছেন। ঢাকা থেকে তার যাত্রা শুরু হয়। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থেকে শেরপুর তারপর কিশোরগঞ্জ পরে আবার ময়মনসিংহের ভালুকায় ফিরে আসেন। বিরতীহীন এমন সাইক্লিং বাংলাদেশে খুব একটা হয়না বলেও জানান ইফাজ।
ইফাজ বলেন, বাংলাদেশের সবকটি জেলাতেই ঘুরেছেন। তার সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি শতবর্ষী বৃক্ষ রক্ষা-ইয়ুথ এগিনেস্ট ড্রাগ এই দুইটা ম্যাসেজ পৌঁছে দেন। এভাবে সাইক্লিং করতে গিয়ে ২০১২ সালে যোগ দেন বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সাথে। পরে তার সাংগঠনিক দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার কারণে স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠন কুমিল্লা সাইক্লিস্ট গ্রুপের এডমিনের দায়িত্ব পালন করছেন ।
চলতি বছর টানা ৪২ দিন সাইকেলে ভারতের ৫ টি রাজ্য ভ্রমণ করেছেন। যার মধ্যে ত্রিপুরা, মিজুরাম, আসাম, মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে। সেখানে সাইকেল ভ্রমনের সময় সাধারণ মানুষের মন উজাড় করা ভালোবাসা পেয়েছেন।
একযুগের সাইক্লিংয়ে ইফাজের ঝুড়িতে বেশ কিছু অর্জন যোগ হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় সাইকেল রেসে পুরস্কার পেয়েছেন, ভারতের লাদাখে অনুষ্ঠিত এমটিভি ডোয়াথলন সার্টিফিকেট অর্জন, র্দীঘতম চলমান বাইসাইকেল সিঙ্গেল লাইনে অংশগ্রহণ করে গিনিজ সার্টিফিকেট অর্জণ করেন। পরে আবারও টিম বিডিসির সাথে ৪৮ ঘন্টায় রিলে সর্বোচ্চ সাইক্লিংয়ে ১৬৭০ কিঃমি পাড়ি দিয়ে গিনেজ সার্টিফিকেট অর্জণ করেন। এছাড়াও বিডি সাইক্লিস্ট হল অব ফেম সার্টিফিকেট অর্জনসহ আরো বেশ কিছু সার্টিফিকেট ও সম্মাননা পেয়েছেন।
সাইক্লিং নিয়ে ইফাজ তার স্বপ্নের কথা বলেন। একযুগের এই নেশা এখন বিশ^ ভ্রমণ করার জন্য মরিযা হয়ে উঠেছে। সে জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পান তাহলে বাংলাদেশের মানচিত্র তুলে ধরবেন বিশ্বের বুকে।
লেখক মনজুরুল আজিম পলাশ বলেন, সাইক্লিং কালচার নিয়ে ইফাজের উচ্চাকাঙ্খা এবং সক্ষমতাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। সাইক্লিং নিয়ে ‘কুমিল্লা সাইক্লিস্ট’ নামে সে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। তরুণ প্রজন্মকে এই পরিবেশবান্ধব বাহন চালনায় উৎসাহী করছে এবং ইতোমধ্যে সাইক্লিং নিয়ে বেশ কয়েককটি বড় -ইভেন্ট আয়োজন করেছে, যাতে দেশ বিদেশের সাইকেল চালকরা এসে যোগ দিয়েছে। মানুষের স্বপ্ন , পরিকল্পনা এবং সাহস যে সবকিছুকে সম্ভব করতে পারে ইফাজ আবার তার প্রমান দিয়েছে।
ইফাজের সর্বশেষ ভ্রমণ ছিল অসাধারণ। সাইকেল নিয়ে ভারতের পাঁচটি রাজ্য পারি দিয়েছে সফলতার সাথে। মূলত এই ভ্রমণ ছিল বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরা মিজোরাম আসাম মেঘালয় এবং পশ্চিম বঙ্গের মানুষ ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে নিজের ভ্রমণ সত্তাটাও আবার আবিষ্কার করা। এই সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো পারি দিতে ইফাজের সময় লেগেছে অনেক দিন।
ইফাজ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন-পরিবেশ রক্ষণ নিয়ে সচেতনতা প্রচার, বৃক্ষরোপন ও রক্তদান উল্লেখযোগ্য। ইফাজ এবং তাঁর সাইকেল বহন করেছে সবুজ-বসবাসযোগ্য আগামী সম্ভাবনার পৃথিবীর এক শান্তিময় আশাবাদী বার্তা। আমি নিশ্চিত পৃথিবীর সাতচূড়া জয়ী ওয়াসফিয়া নাজনীন আর মানুষের ভালোবাসা জয়ী মাহমুদুল হাসান ইফাজের মতন তরুণ প্রজন্মই আগামীতে ‘সেলিব্রেটি’ সংজ্ঞাটিকে যথাযথ করে তুলবে।
এইচআর