পেয়ারার রাজ্যে ফলন কমেছে, পর্যটক বেড়েছে

এস. এম. পারভেজ, ঝালকাঠি প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৩, ০৩:৫৭ পিএম

ঝালকাঠিতে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর পেয়ারা দাম বেশি পেলেও প্রচণ্ড তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হওয়ায় হতাশ কৃষকরা। তবে বিগত বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটকের ভিড় অনেক বেশি।

ঝালকাঠি, বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামের পেয়ারা বাগানকে ঘিরে ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর কারণে দ্রুত সময়ে দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা এ হাটে এসে হৈ হুল্লোরে মেতে উঠেছেন। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে উঠেছে পার্ক ও খাবার দোকানসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এই এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে  পেয়ারার সমারোহ। পদ্মা সেতুর কারণে পেয়ারা বাজার ভালো হলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ও তাপদাহে পেয়ারার ফলন কম হয়েছে। এতে চাষীরা খরচও তুলতে পারবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেছে।

পর্যটকরা পেয়ারাচাষিদের কাছ থেকে কয়েক কেজি পেয়ারা কিনে হাতে উঁচু করে ধরে ছবি তোলেন। তখন তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। বহুল কাঙ্খিত কিছু পেয়েছেন এমন উল্লাসে দেখা গেছে পর্যটকদের।

ঝালকাঠি থেকে ২টি ট্রলার করে সিটি ক্লাব ও পাঠাগারের সদস্য ও তাদের পরিবার নিয়ে প্রায় ৮০ জন ভ্রমন পিপাসু আসেন এ ভাসমান পেয়ারার হাট দেখতে। সংগঠনের সাধারন সম্পাদক মাইনুল হক বাপ্পি জানান, এশিয়া মহাদেশে থাইল্যান্ডের পরে বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারা বাজার ভীমরুলীতে। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন পেয়ারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বাজারটা অনেক সুন্দর। তাই আমরা প্রতি বছরই সংগঠন থেকে পেয়ারা বাগান ভ্রমনের আয়োজন করে থাকি।

ঢাকা থেকে আগত নোমান শুভ বলেন, ‘এখানে আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই।  নেই গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। ভ্রমণের জন্য ডিঙি নৌকা সংকট রয়েছে। সরকার বা জনপ্রতিনিধি যদি এসবের ব্যবস্থা করেন তাহলে এখান থেকেও প্রতিবছর কোটি  কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে।’

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে স্বপরিবারে ভ্রমণে এসেছেন শান্তি রঞ্জন বালা। তিনি বলেন, ‘পেয়ারার ভাসমান হাটের কথা এত বছর ধরে শুনেছি কিন্তু দেখতে পারিনি। এবছর সময় সুযোগ করে স্বপরিবারে ঘুরতে এলাম। অনেক ভালো লেগেছে।  নৌকা ভাড়া করে বাগানে গিয়ে পেয়ারা গাছে উঠে নিজ হাতে পেয়ারা পেড়ে খেতে পেরেছি। এতেই আমাদের ভ্রমণ সফল হয়েছে।’

রাজধানীর ওয়ারী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তুলসি আক্তার। ঝালকাঠির ভীমরুলীতে পেয়ারার ভাসমান হাট দেখতে এসেছেন তিনিও। তুলসি আক্তার বলেন, ‘ এমন একটি ভাসমান বাজার আমাদের দেশে আর নেই। এখানে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। কতটা যে ভালো লাগছে তা বলে শেষ করতে পারবো না।’

বরিশাল মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহসহ অন্যান্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসেছেন শিক্ষা সফরে। তিনি এখানকার আবাসন ও শৌচাগারের ব্যবস্থা নিয়ে  ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পেয়ারার বড়  মোকাম ভীমরুলীতে কোনো আবাসন ও ভালো শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এখানে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক আসেন। তারা আমাদের ওপর একটা বিরূপ ধারণা নিয়ে যান। দক্ষিণাঞ্চলের এ এলাকাকে আরও উন্নয়ন করা দরকার। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত।

জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম বলেন, ‘ঝালকাঠির ব্র্যান্ড পেয়ারা ও শীতলপাটি চাষিদের এতদিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে। কারণ বিশ্বের পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে পেয়ারা রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন। তিনি আরো জানান, “ পেয়ারা বাগানে এসে উচ্চমাত্রার সাউন্ড বক্স বাজিয়ে পরিবেশ দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রথম দিকে কয়েকটি বক্স জব্দ ও জরিমানা করায় এখন পরিবেশ শান্ত হয়েছে এবং সুষ্ঠভাবে ভ্রমণের পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে।

ঝালকাঠি সদর উপজেলা, বরিশালের বানারিপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামজুড়ে রয়েছে পেয়ারা রাজ্য। ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ পেয়ারা অঞ্চলে গতবছরের ন্যায় এবছরও পর্যটকদের আগমন অনেক বেশি। পেয়ারার সবচেয়ে বড় মোকাম সদর উপজেলার ভীমরুলীর ভাসমান হাটে পর্যটকদের নিরাপত্তার সুবিধা দিতে ঝালকাঠি থানা পুলিশের ভুমিকাও প্রশংসাযোগ্য। পর্যটকরা ড্রোন ও ক্যামেরা দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলছেন, ভিডিও ধারণ করছেন।

প্রতি বছর আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই তিন মাস পেয়ারার  মৌসুম হলেও এবছর ফলন দেরিতে হওয়ায় শ্রাবণে  পেয়ারা নামতে শুরু করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান পেয়ার হাট বসে ভীমরুলীতে। এছাড়া হাট বসে ঝালকাঠি জেলার শতদশকাঠি, জগদীশপুর ও মাদ্রা; পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতাকাঠি; বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার নোরারকাঠি, জাম্ভুদ্বীপ, ব্রাহ্মণবাড়ি ও সৈয়দকাঠিতে।  দেশের বেশিরভাগ  মৌসূমী পেয়ারা উৎপাদন হয় এ তিন  জেলার ৫৫ গ্রামে।

পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক ছোট বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন সকালে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসেন পাইকারদের কাছে। তা কিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সড়কপথে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সরবরাহ হচ্ছে পেয়ারা।

ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারাচাষি আল আমিন মিয়া জানান, এবার মৌসুমের শুরুতেই ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। পর্যটকদের কাছে খুচরা বিক্রি করলে প্রতি মণ ১ হাজার টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়।

স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ চাষিদের মতে, প্রায় ৩০০ বছর আগে ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল ও কালাচাঁদ মন্ডলের হাত ধরে ভারতের গয়া থেকে এখানে পেয়ারার আগমন। তখন থেকেই পেয়ারা চাষ শুরু হয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে গোটা আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে।

কুড়িয়ানার নাম অনুসারে ‘কুড়িয়ানার পেয়ারা’ বলে সবার কাছে পরিচিত হলেও পেয়ারার চাষ এখন আর কুড়িয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পেয়ারার চাষ এখন পাশের বিভিন্ন  জেলা ও উপজেলায় বিস্তার ঘটেছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠী, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতাকাঠি, জামুয়া, মাদ্রা; ঝালকাঠির ভীমরুলী, ডুমুরিয়া, জগদীশপুর, কাফুরকাঠি, শতদশকাঠিসহ স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৫৫টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষাবাদ হয়।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। চাষীরা জানান, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিলো এবছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝড়ে গেছে। গাছ পুড়ে গেছে এমন মনে হয়। পেয়ারা বাজার ভাল হলেও লাভবান হতে পারবেন না বলে জানান চাষীরা। এদিকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানের প্রকৃতি প্রেমীরা প্রাকৃতিক নৈসর্গ উপভোগ করার জন্য ভীড় জমাচ্ছেন পেয়ারা রাজ্যে।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে পেয়ারার ফলন কম হলেও পদ্মা সেতুর কারনে দাম অনেক বেশি পাচ্ছেন। এতে ক্ষতি পূষিয়ে উঠতে পারবেন। এ বছর হেক্টর প্রতি সাড়ে ১১ থেকে ১২ মেট্রিকটন পেয়ারার ফলন হয়েছে।

এআরএস