ভয়াল ২০০৪ সাল, বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে জনগণের দাবি আদায়ে রাজপথে ব্যস্ত জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ।
বিকেলের সমাবেশ দুপুরেই কানায় কানায় ভরে ওঠে সমাবেশস্থল। লোকে লোকারণ্য সমাবেশে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর নির্মিত অস্থায়ী একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
ভাষণ শেষ হতেই গ্রেনেডের বিকট শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। নেতাকর্মীরা প্রথম দিকে এটিকে ককটেল হামলা ভাবলেও তাদের ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্রেনেড।
দলীয় নেতাকর্মীদের মানব দেয়াল ও ট্রাকের পাশের গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় সেদিন আওয়ামী লীগ দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও হামলায় ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় ২৪ জনের। এর মাঝে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমান। এতে আহত হন অসংখ্য নেতাকর্মী। তাদেরই একজন ঢাকার কেরানীগঞ্জের সন্তান ও তৎকালীন ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন বিপ্লব।
ঘটনার দিন অস্থায়ী মঞ্চ ট্রাকে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুনছিলেন। হামলার প্রথম গ্রেনেডের আঘাতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে আবার গ্রেনেডের শব্দে তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখেন, আহত-নিহতদের রক্তে ভেজা শরীর। সমাবেশে অংশ নেওয়া লোকজন আহত-নিহতদের ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। যে যার মতো নিরাপদ গন্তব্যে যেতে ছোটাছুটি করছেন।
তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, এলাকাটিতে কোনো যানবাহন না থাকায় মানুষ কাঁধে এবং কোলে করে আহত-নিহতদের হাসপাতালে ও নিরাপদ আশ্রয়ে নিচ্ছিলেন। আমি বহু কষ্টে পাশের একটি দোকানে গিয়ে উঠলেও পুলিশ আতঙ্কে আমাকে দোতলার একটি দর্জির দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে এক দর্জি আমার পড়নের প্যান্টটি কেটে দেন এবং রক্তে ভেজা জুতা খুলে দেন। এসময় আমি সব কিছু দেখলেও কথা বলতে পারছিলাম না। আমি সেখানে থাকতে থাকতে ঘটনাস্থলে আরও ১০/১৫টি গ্রেনেড হামলা হয়।
পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। এক লোক এসে আমাকে জানান নিচে গাড়ি আসছে আমাদের জন্য। তারপর তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সাহেবের গাড়িতে করে আমাকেসহ নয়জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার আগেই কানে আওয়াজ আসতে শুরু করে আহতদের হাসপাতাল থেকেই আটক করা হবে।
সেখানে সামান্য চিকিৎসা শেষে আমাকে গোপনে নিয়ে ভর্তি করা হয় পুরান ঢাকার আরাফাত হাসপাতালে। সেখানেও গ্রেফতার আতঙ্কে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আমার এক সহকর্মীর বাসায়। সেখান থেকে সিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ১০ দিন পর ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে দুই পায়ে অপারেশন করে অসংখ্য স্প্লিন্টার বের করা হয়। তবে আরও বেশ কিছু স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার দুই পায়ে রয়েছে যোগ করেন বিপ্লব।
বিপ্লব বর্তমানে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, এখন ওষুধ খেয়ে মোটামুটি ভালো থাকলেও মাঝে মধ্যেই প্রচণ্ড ব্যথায় দুই পা প্রায় অবশ হয়ে যায়। ব্যাথা হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে ভয়াল দৃশ্য। সেবার দেশদ্রোহীরা বঙ্গবন্ধু কন্য শেখ হাসিনাকে মেরে ফেললে দেশের মানুষ হয়তো দেখতো না এই বাংলাদেশকে। শেখ হাসিনা বেঁচে আছে বলেই আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ।
২১ আগস্টের নারকীয় তাণ্ডবের রায় দেখেছেন, তবে রায় কার্যকর হওয়া দেখে যেতে চান তিনি। আর শুধু ২১ আগস্ট নয় গ্রেনেড হামলায় আহত বীরদের আজীবন কদর চান এই আওয়ামী লীগ নেতা।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মোট ১১ আসামিকে। বাকি তিনজন অন্য মামলায় ফাসি কার্যকর হওয়ায় তাদের কে মামলা থেক অব্যহতি দেয়া হয়
সর্বশেষ পলাতক আছেন ১৫ জন। এরমধ্যে অন্তত ৯ জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
এআরএস