ইলিশের জন্য চাঁদপুর কিংবা দক্ষিণের কিছু জেলা সবসময় আলোচনায় আসলেও এবার এ মাছের নতুন রুট সৃষ্টি হয়েছে ফেনী জেলায়। গত কিছু দিন ধরে এখাকার ফেনী নদীতে প্রচুর ইলিশ পাচ্ছেন জেলেরা এবং এসব ইলিশ আকারেও তুলনামূলক অনেক বড়।ফলে স্থানীয় বাজারে প্রায়ই বিক্র হচ্ছে দুই থেকে তিন কেজি ওজনের ইলিশ মাছ।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে ফেনী নদীতে ইলিশ নিয়মিত মিললেও মাঝে দীর্ঘসময় খুব একটা পাওয়া যেতো না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবার ইলিশ পাচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় , প্রতিদিন ৪০-৫০টি নৌকা ফেনী নদী হয়ে মোহনার দিকে গিয়ে জাল ফেলে এবং কম বেশি প্রতি নৌকাই গড়ে ১০০-১৫০টি ইলিশ নিয়ে বাজারগুলোতে আসছে।
আর বেশিরভাগ ইলিশের আকারই এক কেজির কাছাকাছি কিংবা তার চেয়েও বেশি। এক থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে অনেক।
অবশ্য স্থানীয় সূত্র বলছেন ,তবু্ও অজনা আতঙ্কে দিন কাটে এ জেলার সোনাগাজী উপজেলা জেলেদের।ওই সূত্রের দাবি, ‘অপ্রত্যাশিত কিছু উৎপাতে’র কারণে জেলেরা ইলিশ মাছ দ্রুত বিক্রি করতে চান এবং ইলিশ বেশি পেলেও সেটি প্রকাশ করতে চান না।
সোনাগাজীর মাছের বাজার সম্পর্কে খবর রাখেন এমন এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, কোনো নৌকা ইলিশ মাছ বেশি পেলে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী সেগুলো নদীতে নৌকায় থাকা অবস্থাতেই তাদের কাছে কম দামে বিক্রির জন্য চাপ দেয়।ফলে, বিষয়টি নিয়ে অজানা আতঙ্কে থাকেন তারা।সেজন্য ইলিশ প্রসঙ্গে খুব একটা মুখ খুলতে চান না স্থানীয় জেলেরা।
সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা অবশ্য বলছেন সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার কারণে নদী ও সাগরে জেলেদের জালে ইলিশসহ অন্য প্রজাতির মাছও ধরা পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, `ফেনী নদী ইলিশের একটি রুট। এটি সন্দ্বীপ চ্যানেল হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। এখন ইলিশ নদীতে আসার সময় হচ্ছে। এসব কারণে ইলিশের উপস্থিতি বেড়েছে`
অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ পর্যবেক্ষণ সেলের হিসেবে ১৫ বছর আগে দেশের ২৪ টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। এখন দেশের অন্তত ১২৫ টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে সৃষ্ট বহু চর ও ডুবো চর এবং পদ্মা ও মেঘনার নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশের মিঠা পানিতে আসতে বাধা ও ইলিশের গতি পথ পরিবর্তন হচ্ছে।
এদিকে মৎস্য গবেষকরা বলছেন, ইলিশ মাছ সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের নানা উদ্যোগ আর ফেনী নদীর পরিবেশ বড় আকারের ইলিশকে সেখানে নিয়ে আসছে।
তাছাড়া,সাধারণত অক্টোবর নভেম্বর মাসে ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার পর ডিম থেকে হওয়া জাটকাগুলো পরবর্তী ছয় থেকে সাত মাস নদীতেই বড় হতে থাকে। এরপর ইলিশগুলো সাগরে চলে যায়।
ওই সময়কে লক্ষ্য করেই সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে যাতে করে মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পায়। এক বছর পর একটি ইলিশ পরিপূর্ণ হয় এবং এরপর আবার ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ নদীতে ফিরে আসে।
অক্টোবর নভেম্বর মাস নাগাদ প্রজনন মৌসুম শুরু হলে ইলিশ তখন উজানের দিকে আসতে থাকে।
সম্প্রতি এনিয়ে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছিলেন,ফেনীর সাথে মেঘনার যোগসূত্র আছে। আবার এখন ইলিশের বিচরণও অনেক বেড়েছে। সামনে ইলিশ আরও পাওয়া যাবে কারণ সাগর থেকে ইলিশ এখন উজানের দিকে আসার সময় হচ্ছে ডিম পাড়ার জন্য,
তিনি আরও বলছেন, একটা ইলিশ অন্তত এক বছর বড় হওয়ার সময় পাচ্ছে এখন। “আমরা মনে করি একটা ইলিশকে জীবনে অন্তত একবার ডিম দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। এই সুযোগটা বেড়েছে বলেই প্রজনন সফলতা বাড়ছে ও ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণেই নতুন এলাকায় ইলিশের বিস্তৃতি ঘটছে”।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলছেন, একদিকে ইলিশের মাইগ্রেটরি প্যাটার্নে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে হয়তো ফেনী নদীতে ইলিশ বৃদ্ধিতে সেটি ভূমিকা রেখেছে।
অন্যদিকে তিনি আরও বলছিলেন,"অন্য এলাকায় মাছ ধরার প্রবণতা বেশি কিন্তু সে তুলনায় ফেনী নদীর এলাকাটি কিছুটা নিরিবিলি। এটারও প্রভাব থাকতে পারে"।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। উৎপাদন আরও বাড়াতে বঙ্গোপসাগরের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইলিশের প্রধান প্রজনন এলাকা চিহ্নিতকরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিলো প্রায় তিন লাখ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
এআরএস