* কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় প্রায়শত বছরের পুরোনো বিরোধ সমাধান করল উপজেলা প্রশাসন
* দিন বদলের রূপকার ইউএনও সোহেল রানা
২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার পশ্চাৎপদ উপজেলা ব্রাহ্মণপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন দেশের আলোচিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। তাঁর ইউএনও জীবনের প্রথম আইনশৃঙ্খলা সভার মিটিং এ উপজেলার শিদলাই গ্রামের বড় দল ও ছোট দলের সংঘর্ষের ভয়াবহতার বিষয়ে অবগত হন। সভায় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সুশিল সমাজের বড় একটি অংশ এ নিয়ে বেশ উদ্বেগ জানান।
সভায় উপস্থিত বক্তারা জানান, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার প্রন্তিক গ্রাম শিদলাই। ঐতিহ্যবাহী গ্রামটিতে প্রায় ৮ হাজার লোকের বাস। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হলেও দলগত দ্বন্দ্ব গ্রামের মানুষকে অশান্ত করে তোলে। সামাজিক দ্বন্দ্বেও বিরূপ প্রভাব পড়ে সবখানে। এ গ্রামে বড় দল ও ছোট দল নামে দুটি পক্ষ বংশপরম্পরায় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে প্রাণহানি, পাল্টাপাল্টি মামলা, হয়রানি ও বসতঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। দুই দলের শতবর্ষী দলাদলিতে উভয় দলের ৪০ এর অধিক মানুষ প্রাণহারান।
সর্বশেষ এক বাড়ির টিনের চালের পানি অন্য বাড়িতে গড়িয়ে পড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া একটি হামলার জের চলে ৩ বছর। ভাঙচুর হয় ৫৫টি বাড়িঘর, চলে লুণ্ঠণ, পাল্টাপাল্টি মামলা হয় ১৫টি, বের হয় দুই শতাধিক ওয়ারেন্ট।
মামলাকারীরা প্রতিপক্ষের রোষের ভয়ে ফেরারি জীবন যাপন করতে করেন, অপরদিকে আসামিরা গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ান। ফলে গ্রাম হয়ে পড়ে পুরুষশূন্য। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে তরুণ ইউএনও সোহেল রানাকে। এরপর এ নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।
বিরোধগুলোর গতি প্রকৃতি নিয়ে তিনি স্টাডি করে প্রথমে শিদলাই শান্তি পরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান উপদেষ্টা করেন স্থানীয় সাংসদ আবুল হাসেম খানকে, উপদেষ্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ জাহের ও কমিটির সদস্য করা হয় উপজেলার আট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে, নিজে দায়িত্ব পালন করেন সভাপতি ও সমন্বয়ক হিসেবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) করা হয় সদস্যসচিব। কমিটির সদস্যরা দুই মাস ধরে শিদলাই গ্রামের বড় দল ও ছোট দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলেন, নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এরপর সেবছর ৪ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন হয়। এই চুক্তিই ঐতিহাসিক শিদলাই চুক্তিনামা হিসেবে পরিচিত।
বিরোধ নিষ্পত্তিতে ৯টি শর্ত আরোপ করেন। সেগুলো হলো-
১. চুক্তির দিন থেকে গ্রামে আর কোনো দলপথা থাকবে না।
২.দ্রুততম সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষের উত্তেজনা ও দূরত্ব কমিয়ে অতীতের সকল মামলা প্রত্যাহারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. ২০১৬ সালে সৃষ্ট সহিংসতায় ছোট দলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চুক্তি মোতাবেক তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
৪.৮৮ বছরে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনার একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণাধর্মী রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে যা পরবর্তীতে কখনও প্রয়োজন হলে প্রমাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
৫. উচ্চ ক্ষমতাসপন্ন শিদলাই শাস্তি পরিষদ নামের একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির অধীন চুক্তির যাবতীয় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রিত হবে।
৬. কান্তি চুক্তিকালীন একজন পুলিশের উপ পরিদর্শকের নেতৃত্বে শান্তির পাহারাদার নামক একটি স্বেছাসেবী টিম গঠন করা হবে।
৭. নির্দিষ্ট দিনে উভয় পক্ষ সব ধরনের অস্ত্র জমা দিবেন।
৮. ভবিষ্যতে যাতে দলাদলি আর না হয় এবং তাদের মানস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দূরীকরণে দেশবরেণ্য সাইকোলজিস্টদের নিয়ে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা হবে।
৯. উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমাতে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে একে অপরকে দাওয়াত দিবেন।
চুক্তি সম্পাদনের পর গত ১ বছর ৯ মাস ধরে চুক্তি বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যান উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
এই শাস্তিচুক্তির ফলে প্রায় ৩শ’ জন ফেরারি মানুষের ঘরে ফিরে আসেন, শুরু করেন স্বাভাবিক জীবনযাপন। দুই পক্ষের মাঝে চলমান ১৩টি মামলার মধ্যে দুই হত্যা মামলা (আপোষযোগ্য নয়) বাদে সবগুলো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও পুনর্বাসনে দেড় কোটি টাকা আদায়ের কথা ছিলো চুক্তিতে। যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থদের মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই টাকা উপজেলা চয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি পুনবার্সন কমিটির মাধ্যমে বন্টণ করা হয়। শাস্তিচুক্তির পর দুই দলের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র টেঁটা, বল্লম ও লাঠিসোঁটাসহ বিপুল পরিমাণ দাঙ্গায় ব্যবহৃত দেশি অস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে শিদলাই আমির হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজের মাঠে জমা নেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দলাদলি বন্ধে আনুষ্ঠানিক শপথ পাঠ করান সংসদ সদস্য আবুল হাসেম খান।
এলাকায় শান্তি যাতে কখনো বিঘ্নিত হতে না পারে সেজন্য দুই পক্ষ থেকে ১০ জন করে মোট ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক পুলিশের একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম দেওয়া হয় শান্তির পাহারাদার।
এই শান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে গ্রামগঞ্জে বেড়ে ওঠা এসব মানুষের মানস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন ইউএনো সোহেল রানা। এই উদ্দেশ্যে শিদলাই আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজে ২১ ও ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর ও প্রভাষক আয়েশা সিদ্দিকা দলপ্রথায় যুক্ত মোট ১০৬ জনকে নিয়ে দুই দিনে ৮ ঘন্টার সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সেশন পরিচালনা করেন।
সর্বোপরি বিরোধ নিরসনে শিদলাই শান্তিচুক্তি একটি মডেল এর মতো যেখানে ভবিষ্যৎ বিরোধের কথা ভেবে অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যুগান্তকারী এ চুক্তিকে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মাইলফলক হিসেবে অখ্যায়িত করেন।
স্থানীয় সাংসদ থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, সুশিল সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এই ইস্যুতে এক বিন্দুতে মিলিত হন। এই চুক্তির পর থেকে শিদলাই গ্রামে বড় দল ও ছোট দল নামে কোনো দল নেই। প্রায় শতবর্ষের রক্তাক্ত জনপদে বইছে শান্তির সুবাতাস।
শিদলাই শান্তি চুক্তি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মানুষের জন্য এক বিরাট স্বস্তির নাম কারণ শিদলাই গ্রামের হানাহানির ইতিহাস এই অঞ্চলে অনেকটা রূপকথার মতো প্রচলিত। এই হানাহানির বিষবাষ্প শিদলাই ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নে। ফলে, গোটা উপজেলায় শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই চুক্তি একটি মাইলফলকের মতো। গ্রামীণ এসব হানাহানিতে অতিষ্ঠ জনসাধারণ এই ধরণের শান্তি চুক্তি প্রক্রিয়াকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন উপজেলা প্রশাসনের এই ধরণের উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় শান্তি আনয়নের চেষ্টা বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংযোজন যা বিরোধ মেটাতে হতে পারে পুরো বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত।
এ প্রসঙ্গে শিদলাই গ্রামের এক দলের নেতা সোহেল রানা বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা দলাদলি, সংঘাত ইউএনও স্যারের পদক্ষেপে বন্ধ হয়েছে। আগে আমাদের ঘরবাড়ি ছিল না। বাচ্চারা পড়াশোনা করতে পারত না। চরম সংকটে দিন কাটতো আমাদের পরিবারের। বর্তমানে আমরা অনেক সুখে-শান্তিতে বাস করছি।
ততকালীন ব্রাহ্মণপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা জানান, শিদলাইবাসীর করুন কাহিনী। তিনি বলেন, হামলা-মামলায় জর্জরিত একটি গ্রাম ছিল শিদলাই। গ্রামের পুরুষরা মামলার ভয়ে ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত পালিয়ে বেড়িয়েছে।
ব্রাহ্মণপাড়ার ইউএনও সোহেল রানা নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির যে পদক্ষেপ সেটি ব্রাহ্মণপাড়ার ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। আমরা থানা পুলিশ এক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করি। শদিলাইবাসী এখন শান্তিতে বাড়িতে ঘুমাতে পারে। দলাদলি আর দাঙ্গা হাঙ্গামায় জর্জরিত শিদলাই এখন একটি শৃঙ্খলা গ্রামে পরিণত হয়েছে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবু জাহের বলেন, শিদলাই শান্তিচুক্তি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। অতীতে যেসকল আপোষ মিমাংসা হয়েছে তাতে স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি, কিন্তু শিদলাই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন সচেষ্ট হলে যেকোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত সমূলে উৎপাটন সম্ভব। এ শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অশান্ত গ্রামটিতে শান্তি বিরাজ করছে। এটি পুরো উপজেলায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এআরএস