তাজরীন ট্রাজেডির ১১ বছর আজ

শারীরিক অক্ষম শ্রমিকদের দূর্বিষহ জীবন, থমকে আছে বিচার!

হাসান ভুঁইয়া, আশুলিয়া (ঢাকা) প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৩, ১১:১১ এএম

তাজরীন ট্রাজেডির ১১ বছর পূর্তি হলো আজ কিন্তু শেষ হয়নি নিহতের পরিবারের আহাজারি ও আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবার আকুতি। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সামান্য সহযোগিতায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও আতঙ্ক কাটেনি শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়া শ্রমিকদের। অনেকটা অবহেলার মধ্য দিয়ে এখন তারা দূর্বিষহ জীবন পার করছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে পোশাক তৈরি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে একসঙ্গে এত শ্রমিক হতাহতের ঘটনা এটাই প্রথম। যে কারণে এই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক পালনের পাশাপাশি সারা দেশের পোশাক কারখানা গুলোকে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

২০১২ সালে ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকার তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিলো। এ ঘটনায় ১১৩ জন শ্রমিক জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন আরও অন্তত শতাধিক। যদিও নিহত ও আহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

কারখানাটিতে এক হাজার ১৬৩ শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে কারখানার সকল মালামাল ও সম্পূর্ণ ভবনটি। সেই পুড়ে যাওয়ার ছাপ এখনো ভবনের চার পাশে লেগে আছে। সেদিনের পর থেকে ভবনটির কর্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলেও পুড়ে যাওয়া ৮ তলা ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাররা সহ ভবনের আশে পাশের বাড়িওয়ালারা।

শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় জরাজীর্ণ তাজরিন ফ্যাশনের সামনে গিয়ে দেখা যায় এ দিনটির স্বরণে কারখানাটির সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে নিহত শ্রমিকদের পরিবারের স্বজন ও আহত শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

অন্যদিকে ২৪ নভেম্বরের এই দিনটিকে ঘিরে ভবনটির গেটে বিভিন্ন ধরণের পোষ্টার লাগানো হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে পুরে যাওয়া ভবনটির সামেন গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির প্রধান গেটে তালা ঝুলানো। এখানো ভবনটির প্রত্যেক জানালায় আগুনের ছাপ লেগে আছে।

আশপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সময় আশপাশের বাড়ির টিন সেড ঘরের প্রায় ১৫টি কক্ষ পুড়ে গেছে। তারা সব সময় আতঙ্কে থাকেন কখন আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। তাই তাদের দাবি এই ভবনটি ভেঙে ফেলা হোক।

এ ভবনটি নিয়ে আতঙ্কে দিন পাড় করা ওষুধ ব্যবসায়ী হৃদয় বলেন, কারো যদি মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তাহলে কি সে দাড়াতে পারে? পারে না। আমি মনে কি এই ভবনটির মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এই ভবনের কারণে আরও দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এই ভবনটি ভেঙে ফেলা উচিত।

তাজরীনের আহত শ্রমিকদের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এই প্রতিবেদকের, এ সময় তারা জানান, তাদের দাবি হচ্ছে ন্যায্য ক্ষতি পুরণ, পূর্ণবাসন ও দীর্ঘ মেয়াদী সুচিকিৎসার। সেই সাথে তাজরীন ফ্যাশনের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

তাজরীনের আগুনে পুড়ে যাওয়া আহত শ্রমিক রেহেনা আক্তার বলেন, আমি একজন তাজরীনের অসুস্থ শ্রমিক। আমার মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙা। আমি কোনো কাজ-কাম করতে পারি না। আমি বর্তমানে ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। আমার ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাইতে পারছি না। অন্যকোথাও চাকরিও হচ্ছে না। আমরা আহত তাই কেউ চাকরিতে নেই না। আমার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়। তাই আমার দাবি চিকিৎসা দিলে ভালো মত দেওয়া হোক। সেই সাথে সরকারের কাছে আবেদন আমাদের দ্রুত ক্ষতি পূরণটা দেওয়া হোক।

নাসিমা আক্তার নামের আরেক আহত শ্রমিক বলেন, আমার মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙা। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচতে হবে। বর্তমানে আমি একটি ঝুটের গোডাউনে দিনে ২০০ টাকা রোজে কাজ করি। সেখানে যেতে আমি বাধ্য হয়েছি। কারণ অন্য আমার চাকরি হচ্ছিল না। আমি অনেক ফ্যাক্টরির সামনে গিয়েছি। তাই আমার দাবি ন্যায্য ক্ষতি পুরণ ও দীর্ঘ মেয়াদী সুচিকিৎসার দেওয়া হোক। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরাসরি কথা বলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

শ্রমিকনেতা খোরশেদ আলম বলেন, তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডের প্রায় এক যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় শুনেছি, অনেকে আমাদের কাছে অভিযোগও করেছেন তাজরীন গার্মেন্টেসের শ্রমিকদের অন্যকোথাও চাকরি হচ্ছে না। কারণ তারা তো আহত তাদেরকে নিলে তার ঠিকমত প্রোডাকশন করতে পারে না। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই আহত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানসহ এদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা সরোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ অগ্নিকাণ্ডে পুরে যাওয়া ক্ষতি ভবনটি ভেঙে বা সংস্কার করে এখানে তাজরীনের আহত শ্রমিক ও নিহত শ্রমিকদের পারিবারের বাসস্থান করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। তবে আমাদের এই দাবির কোনো প্রতিফলন দেখছি না। অন্যদিকে এই মামলার বিচারকার্য থেমে আছে, তারও কোনো অগ্রগতি দেখছি না।

অন্যদিকে ভয়াবহ ওই ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলা দায়েরের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। তবে রাষ্ট্র পক্ষ আশা করছে, খুব দ্রুতই শেষ হবে বিচারকাজ।

জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তাজরীন ফ্যাশন এর মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন তার মেয়ে তাজরীনের নামানুসারেই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেছিলেন।

এআরএস