দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামে ১৬টি সংসদীয় আসনে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচন।ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন এবং পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত করেন।
আওয়ামীলীগ সরকার টানা ক্ষমতায় থাকায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ভোটাররা নৌকায় ভোট দিয়ে নৌকার জয়জয়কার করেন। চট্টগ্রাম ১৬টি আসনের মধ্যে ১৪ টিতে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।বাকি দুটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মহাজোটের হয়ে লাঙ্গল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী করেন। এরমধ্যে চট্টগ্রামের ১৫ ও ১৬ নং আসনে নৌকার ভরাডুবি হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বা নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী জয় লাভ করেন এবং ৮নং আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত হয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জয়লাভ করেন।
নির্বাচনের শুরু থেকে ১৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি আসন ছাড়া বাকী সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর গর্জন ছিল নৌকার ভয় পাওয়ার মতো।তবে দিন শেষে নৌকার জয়জয়কার হয়েছে।এরমধ্যে চট্টগ্রামে ১৫ আসনে নৌকার প্রার্থী আবু রেজা নদভীর বিরুদ্ধে আ.লীগসহ সাধারণ মানুষ চরম বিরোধিতা করে পরাজিত করেন।অপরদিকে চট্টগ্রাম-১৬আসনের নৌকার প্রার্থীর প্রার্থিতা ভোটের দিন বাতিল করেন নির্বাচন কমিশন। এই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭৬ ভোটে চতুর্থবারের মতো এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী পেয়েছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৭৮৪ ভোট। শিক্ষাউপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৯৩ ভোট, রাউজানের জনপ্রিয় এমপি পঞ্চমবারের মতো সংসদে যাচ্ছেন ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭২ ভোটে।
মিরসরাইয়ে মোশাররফপুত্র মাহবুব উর রহমান রুহেলের কাছে পাত্তা পাননি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন।
ফটিকছড়িতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনির কাছে পরাজিত হন। নৌকার ‘ভাগ’ না পাওয়া তরিকতের নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী শেষ মুহূর্তে এসে নৌকার সঙ্গে ‘হাত মিলিয়ে’ ভোটের মাঠে ছিলেন না। খাদিজাতুল আনোয়ার ১ লাখ ৩৭০ হাজার ভোটে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য হয়েছেন। মাত্র ৩৬ হাজার ৫৮৭ ভোটে তাঁর পেছনে রয়েছেন স্বতন্ত্র তৈয়ব।
সন্দ্বীপের নৌকার মাঝি মাহফুজুর রহমান মিতা হ্যাট্রিক করেছেন। আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কাণ্ডারি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়েছেন ২৬ হাজার ৬৮৬ ভোটে। তিনি পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৭৫৬ ভোট।
চট্টগ্রাম-৪ সীতাকুণ্ড আসনে নৌকার প্রার্থী এস এম আল মামুন বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৪২ হাজার ৭০৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির দিদারুল কবির চৌধুরী লাঙল প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৮০ ভোট।
‘জোটবন্ধু’ জাতীয় পার্টির কথা রেখেছে আওয়ামী লীগ! `আওয়ামী` স্বতন্ত্রের বাধায় বাদল-মোসলেমের আসনে সোলায়মান আলম শেঠ বসতে না পারলেও চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ঠিকই বসে গেছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ১৪ হাজার ৭২৬ ভোট বেশি পেয়ে `আওয়ামী` স্বতন্ত্র মোহাম্মদ শাহজাহানকে মাড়িয়ে এসেছেন। আনিসের প্রাপ্ত ভোট ৫০ হাজার ৯৭৭ ভোট। চবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাহজাহান পেয়েছেন ৩৬ হাজার ২৫১ ভোট।
চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে নোমানের নৌকা `নোঙর` করিয়ে আসন ভাগে নিলেও প্রচার-প্রচারণার মাঠের মতো ভোটযুদ্ধের ধারেকাছেও আসতে পারেননি জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ। তাঁকে ‘কোণঠাসা’ করে লড়াই হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী এবং সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের মধ্যে। ৭৮ হাজার ভোটে সংসদ সদস্য হিসেবে নোমান আল মাহমুদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছালাম। ৮ ঘণ্টার ভোটযুদ্ধে বিজয় কুমার চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট সাড়ে ৪১ হাজার।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর) আসনে আবারো নির্বাচিত হয়েছেন এই আসনের তিন মাসের এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চু। সাবেক সিটি মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমের সঙ্গে তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেলেও ভোটের ফলাফলে এর ছিটেফোঁটাও নেই। গেলবার নৌকার টিকিট চাওয়া এই প্রার্থীর সঙ্গে মহিউদ্দিন বাচ্চুর ভোটের ব্যবধানে বিস্তর ফারাক। মহিউদ্দিন বাচ্চু পেয়েছেন ৬৯ হাজার ২৪ ভোট। আর মনজুর আলম পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৫৩৫ ভোট।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে চারবারের এমপি ও ব্যবসায়ী নেতা এম এ লতিফকে ‘ধরিধরি’ করেও ধরা হলো না `আওয়ামী` স্বতন্ত্র প্রার্থী কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের। মাত্র ৪ হাজার ৯৬৯ ভোটে হেরে গেছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এই নেতা। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৪৬ হাজার ৫২৫ ভোট। ৫১ হাজার ৪৯৪ ভোটে পঞ্চমবারের টানা এমপি হলেন এম এ লতিফ।
দিনভর ‘নাজুক’ অবস্থার অবসান হয়েছে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর। কেন্দ্রে কেন্দ্রে তাঁকে পড়তে হয়েছে ‘অপ্রীতিকর’ পরিস্থিতিতে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ১ লাখ ২০ হাজার ৩১৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এ আসনে ভরাডুবি হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর। নির্বাচনে তিনি হেরেছেন ৮৫ হাজার ৭৩ ভোটের ব্যবধানে।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া) আসনে স্বতন্ত্রের ঢেউ সামলে টিকে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে একূল-ওকূল হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল জব্বার চৌধুরী। নজরুল ইসলাম চৌধুরী পেয়েছেন ৭১ হাজার ১২৫ ভোট আর জব্বারের ভাগে ৩৬ হাজার ৮৮৪ ভোট।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. আবু রেজা নেজামুদ্দীন নদভী ৪৬ হাজার ৩৭৬ ভোট ব্যবধান এম এ মোতালেবের কাছে পরাজিত হন। এম এ মোতালেবের প্রাপ্ত ভোট ৮৫ হাজার ৬২৮। ৩৯ হাজার ২৫২ ভোটে ‘নৌকা’ ডুবেছে দুইবারের এমপি নদভীর।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে থানায় গিয়ে প্রার্থিতা হারিয়েছেন নানাকাণ্ডে বিতর্কিত এমপি মোস্তাফিজুর রহমান। স্বতন্ত্র হয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মুজিবুর রহমান যেন আওয়ামী লীগের ‘নৌকার’ বাকিপথ টেনে আনলেন! ৫৭ হাজার ৪৯৯ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো তাঁকে সংসদে বসার সুযোগ করে দিল ভোটাররা। মোস্তাফিজ-মুজিবের ‘ধাক্কাধাক্কি’তে সুবিধা করেছেন আরেক `আওয়ামী` স্বতন্ত্র আবদুল্লাহ কবির লিটন।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে এবার মোট ভোটার ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৩৯৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৫৯০ জন, নারী ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৫৬ জন।
চট্টগ্রামের সব আসন মিলিয়ে মোট ভোটকেন্দ্র ২০২৩টি এবং ভোটগ্রহণ কক্ষ ১৩ হাজার ৭৩২টি। প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৪৩ হাজার ২১৯ জন। ১০ শতাংশ অতিরিক্তসহ ভোটগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন মোট ৪৭ হাজার ৫৪৪ জন।
আরএস