কাপড়ের রঙ ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে বেকারি পণ্য

আল-আমিন মিনহাজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪, ০৫:৩১ পিএম

কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর এলাকায় খাদিজা বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারিতে কাপড়ের বিষাক্ত রঙ ব্যবহার করে বিস্কুট, কেক, পাউরুটিসহ তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের মুখরোচক খাদ্যপণ্য।

কেরানীগঞ্জের বেশিরভাগ বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণেও রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। এছাড়াও পণ্য রাখার ঘর যেমন অপরিষ্কার, তেমনি পোকামাকড়ে ভরপুর। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। থাকলে মান বজায় রেখে উৎপাদন করা হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ বেকারির নেই ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ, স্যানিটারি ও ট্রেডমার্ক ছাড়পত্র। ফলে তদারকির অভাবে উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেকারি।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এসব খাদ্য মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা, আগানগর, তেঘরিয়া, বাস্তা, রোহিতপুর, শাক্তা, কালিন্দী গদাবাগ এলাকাসহ ইউনিয়নগুলোর আনাচেকানাচে অসংখ্য বেকারি গড়ে উঠেছে। সরকারের অনুমতি ছাড়াই মানহীন পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে এসব বেকারি। এসব বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মিষ্টিসহ নানা মুখরোচক পণ্য।

স্যাঁতসেঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে বেকারিসামগ্রী। বেকারিতে ব্যবহৃত জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। শ্রমিকরা খালি পায়ে এসব পণ্যের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। আটা-ময়দা প্রক্রিয়াজাত করার কড়াইগুলোও অপরিষ্কার ও নোংরা। ডালডা দিয়ে তৈরি করা ক্রিম রাখা পাত্রগুলোতে ভনভন করছে মাছির ঝাঁক। কয়েক দিনের পুরোনো তেলেই ভাজা হচ্ছে পণ্যসমাগ্রী। অপরিচ্ছন্ন হাতেই প্যাকেট করা হচ্ছে এসব পণ্য। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ছাড়াই বাহারি মোড়কে বিভিন্ন ধরনের বেকারিসামগ্রী বাজারজাত করা হচ্ছে।

উপজেলার আব্দুল্লাহপুর এলাকার খাদিজা বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারিতে গিয়ে দেখা যায়, আট থেকে দশ বছরের শিশুদের দিয়ে করানো হচ্ছে ভারি কাজ।

বেকারির মালিক ডালিম আহমেদের কাছে সরকারি অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আগে ছিল এখন নেই। বহু বছর ধরেই লাইসেন্স ছাড়া বেকারির ব্যবসা করে আসছি।

বেকারির কর্মচারী শামীম বলেন, দিনের বেলায় তারা পণ্য উৎপাদন করেন না। রাতে শুরু করে ফজরের আগেই উৎপাদন কাজ শেষ করেন। সকালে ভ্যানগাড়ি করে দোকানগুলোতে সাপ্লাই করা হয়।

শুধু খাদিজা বেকারি নয় উপজেলার তিতাস বেকারি, স্টার বেকারি, জনতা বেকারি, ঢাকা নূর বেকারি, মায়ের দোয়া বেকারি, মজিদ বেকারি, মিম বেকারিতেও মিলবে একই চিত্র।

অনিয়মের কথা স্বীকার করে বেকারি মালিক ডালিম আহমেদ জানান, বেকারির স্থানটি বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ায় কিছুটা অপরিষ্কার। আলোর অভাব তবে, ভবিষ্যতে বেকারির পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন বলে জানান তিনি।

আয়েশা খাতুন নামের এক ভোক্তা বলেন, বেকারি থেকে বাচ্চাদের জন্য এক প্যাকেট কেক নিয়েছিলাম। বাসায় গিয়ে দেখি বেশিরভাগ কেক নষ্ট ও পচা। বাচ্চারা বলছে দুর্গন্ধ। বেকারিতে কেকগুলো নিয়ে গেলে প্রথমে তারা পাল্টে দিতে চায়নি। কেকের উৎপাদন ও মেয়াদের কোনো তারিখ নেই।

এদিকে কালিন্দী ইউনিয়নের স্টার বেকারিতে প্রশাসন অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা করে বন্ধ করেছিল। কিন্তু তারা গোপনে রাতের অন্ধকারে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

তারা বলেন, শুধু ক্ষতিকর রঙ নয়, দীর্ঘদিনের পোড়া তেল, পচা ও নষ্ট চিনির রস মেশানো হচ্ছে খাবারে। মনগড়াভাবে লেখা হচ্ছে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ। ওজনেও দেয়া হচ্ছে কম।

বেকারির মালিক পরিচয় দিয়ে মাহবুব আলম বলেন, আপনাকে কেন অনুমোদনের বিষয় বলবো। নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব ঠিকঠাক মতোই আছে।

উপজেলার কদমতলি গোলচত্বর এলাকার চা দোকানদার বাবু মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ফুটপাতে চা-পান বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাই। বেকারির তৈরি এসব খাবার উৎপাদনের তারিখ দেখার সময় নাই। আর ক্রেতারা তো আর এসব জিজ্ঞেস করে না।

ভেজাল খাদ্যপণ্যের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে এসব খাবার না খাওয়ার পরামর্শ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ভেজাল কেমিক্যাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি এসব খাবার খেলে পেট ব্যথা, চর্মরোগ, কিডনিতে সমস্যা, খাদ্যনালিতে সমস্যা, শরীর দুর্বলসহ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের খাবার অবশ্যই আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ভেজাল খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তারপরও কোথাও অনিয়ম হলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ফয়সল বিন করিম জানান, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো বেকারি পণ্য উৎপাদন বা বাজারজাত করতে পারবে না। এসব বেকারির বিরুদ্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ইএইচ