অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় ৪০ দিনের কর্মসূচিতে শ্রমিক কাজ করেনি একদিনও। নির্ধারিত প্রকল্পের কোথাও শ্রমিকরা কাজ করেছে, এমন প্রমাণও মেলেনি স্থানীয়দের কাছ থেকে। এ কর্মসূচির কাজ কখন শুরু হয় আর কখন শেষ হয়, তাও জানেন না এলাকাবাসী।
এমনকি যাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে কর্মসূচির টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, সেটিও জানে না তারা।
এভাবেই ধোঁকাবাজির মধ্যদিয়ে শ্রমিকদের নামে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এনামুল হকের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অতিদরিদ্র কর্মক্ষম বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য ৪০ দিনের কর্মসূচির (২য় পর্যায়) কাজ গত বছরের ৩০ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হয় ৭ জুন।
এতে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ৪১টি প্রকল্পে ১১৬৫ জন শ্রমিক রয়েছে এ কর্মসূচির আওতায়।
কাগজে-কলমে কর্মসূচির কাজ দেখানো হলেও মাঠে শ্রমিক কাজ করেছে এমন নজির নেই স্থানীয়দের কাছে। তবুও শ্রমিকদের নামের বিকাশ অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে সরকার নির্ধারিত মজুরির টাকা।
আর পিআইও’র প্রত্যক্ষ মদদে বিকাশ অ্যাকাউন্ট সিম ভাগ-বাটোয়ারা করে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে ভেস্তে যেতে বসেছে এ উপজেলার প্রকল্পগুলো।
এ নিয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হলেও তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেছেন পিআইও এনামুল হক।
এদিকে নিয়মানুযায়ী, কোনো কাজ শুরুর পূর্বেই প্রকল্প স্থলে প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত সাইনবোর্ড স্থাপন করার নিয়ম থাকলেও, তিনি ওই সকল নিয়ম নীতির উপেক্ষা করছেন। ঘাটাইলের ১৪টি ইউনিয়ন ঘুরে তা কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি।
উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ওয়েজ প্রকল্পের তালিকায় ১২ নম্বরে রয়েছে আনেহলা ইউনিয়নের ‘ডাকিয়াপটল ময়েন উদ্দিনের বাড়ি থেকে ভোলা মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ নামে একটি প্রকল্প।
সরেজমিনে স্কুলছাত্র সামী, ফাহিম ও রবিনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, এ রাস্তায় কোনোদিন শ্রমিকদের কাজ করতে দেখিনি।
ওই গ্রামের ব্যবসায়ী সুরুজ মিয়া জানান, ৫-৭ বছরের মধ্যে ৪০ দিন শ্রমিকের কোনো কাজ হয়নি।
অপরদিকে, তালিকার ১৩ নম্বরে রয়েছে দিঘলকান্দি ইউনিয়নের ‘দত্তগ্রাম বাচ্চু মিয়ার বাড়ি থেকে খাদেমের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা এবং দত্তগ্রাম হাফিজের পুকুর পাড় থেকে দত্তগ্রাম রফিক বিএসসির বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা ও মাদারীপাড়া শামীমের বাড়ি থেকে মদিনার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ নামে একটি প্রকল্প।
ওই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান জানান, এখানে ভেকু (এস্কেভেটর) দিয়ে দু-দিন একটু কাজ করতে দেখেছি। তাছাড়া কোনো দিন কোনো শ্রমিক এখানে কাজ করেনি।
একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রত্যেক ইউনিয়ন থেকে ২৪-২৫টি সিম নিয়েছে পিআইও এনামুল হক। এতে ১৪টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩৩৬ জন শ্রমিকের নামে বিকাশ অ্যাকাউন্টে সিম নেন পিআইও এনামুল হক।
শ্রমিকের তালিকায় থাকা যোগিহাটি গ্রামের রেনু বেগম জানান, আমি এখন পর্যন্ত ৪০ দিনের কাজ করিনি। ৬-৭ বছর আগে এক মেম্বার আমার কাছ থেকে ভোটার আইডি আর ছবি নিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমি কিছু জানি না।
এ প্রকল্পের বিল প্রস্তুত হয় ফিল্ড সুপারভাইজার ও ট্যাগ অফিসারের প্রত্যয়নের ভিত্তিতে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্যাগ অফিসার জানান, বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর দিতে হয়। তিনি এ উপজেলায় ১ যুগেরও অধিক সময় ধরে কর্মরত রয়েছেন। সে সুবাদে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সাথে রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। তাই তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে পিছপা হন না।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম লেবু জানান, ৪০ দিন কর্মসূচি প্রকল্পে কোনো কাজ হয় না। শ্রমিকদের সিম থাকে পিআইও আর চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে। আর এ কাজের নাটের গুরু পিআইও এনামুল হক। তিনিই চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বাধ্য করান।
২০২২-২৩ অর্থবছরে (২য় পর্যায়) শ্রমিক কাজ করেছিল কিনা জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এনামুল হক বলেন, এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই।
ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান জানান, এ রকম হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইএইচ