সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজনের আত্মহত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জানলে অবাক হবেন যে, গত তিন মাসে শুধু আশুলিয়াতেই ২৮ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই হিসেবে গড়ে প্রায় তিন দিনে একজনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশের তথ্য অনুসারে ২৮ জন হলেও বাস্তবে এর সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
আশুলিয়া একটি শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা। সেহেতু এখানে লাখ লাখ মানুষের বসবাস। যাদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন। এখানে বসবাসকারীদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক। যারা গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন।
যেহেতু এই শিল্পাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষের বসবাস সেই হিসেবে অপ্রত্যাশিত ঘটনার সংখ্যাও কিন্তু অনেক বেশি। তাই বলে এত আত্মহত্যার ঘটনা কারোরই কাম্য নয়। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের ফল বলে ধারণা করছেন সমাজের বিশিষ্ট জনরা।
গত তিন মাসে ঘটে যাওয়া ২৮টি আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে ২৫টি আত্মহত্যা ঘটনা ঘটেছে ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ পানে ৩ জন। এদের মধ্যেও পুরুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি। তবে নারীদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ২৮ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে পুরুষ রয়েছে ২২ জন ও নারী আছে ৬ জন।
তিন মাসের মধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ জানুয়ারিতে ১০টি আত্মহত্যা ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে ৬ জন পুরুষ, ৪ জন নারী, ফেব্রুয়ারিতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৯টি, যার মধ্যে পুরুষ ৬ জন ও নারী ৩ জন। এছাড়াও গত মার্চ মাসে আরও অন্তত ৯টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যেও ৬ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী রয়েছে।
সবগুলো ঘটনায় আশুলিয়া থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। এ সকল ঘটনার পরপর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহতের মরদেহ উদ্ধারসহ মরদেহের ময়নাতদন্ত করেছে।
বিভিন্ন ঘটনার বরাত দিয়ে থানা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে পারিবারিক কলহের জেরে। এছাড়াও প্রেম সংক্রান্ত, শারীরিক অসুস্থতা ও ঋণগ্রস্ততার কারণেও কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
আত্মহত্যার ঘটনাগুলো খুঁজতে গিয়ে আমরা স্ত্রীর সামনে স্বামীর আত্মহত্যা, স্ত্রীর পরকীয়ার জেরে স্বামী আত্মহত্যা, প্রেমিকাকে হত্যার পর প্রেমিকের আত্মহত্যা, অসুস্থ হয়ে পরিবারের বোঝা না হতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মত ঘটনা দেখেছি।
আত্মহত্যার রোধে আমাদের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমাম হাসান ভুঁইয়া বলেন, আত্মহত্যার যে মূল কারণ তা হলো তার পারিবারিক, আর্থিক অনটন, বিফলতা অথবা হতাশা। এই থেকেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিচ্ছে এবং পরিবারের পক্ষ থেকে সম্পর্কের অবনতি, অবহেলা এটাও একটা কারণ। আমরা দিনে দিনে পরিবারের সদস্যদের প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। যার ফলে একে অপরের প্রতি সম্পর্কের অবনতি হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে যদি সকলের প্রতি সকলে খেয়াল রাখি সম্পর্কটা আরও বাড়িয়ে দেই। তাহলে হয়তো আত্মহত্যার সংখ্যা কমে আসবে।
আত্মহত্যা রোধে পুলিশের কিছু করণীয় আছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এএফএম সায়েদ বলেন, আমরা আত্মহত্যাসহ নানা ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণের সাথে কথা বলি। আমরা সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। পাশাপাশি আমি মনে করি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে বিস্তার আলোচনা করা উচিত। যাতে করে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীসহ সমাজের সাধারণ মানুষ সচেতন হয়।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনুষদের ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, যেহেতু আশুলিয়া একটি শিল্পাঞ্চল সেহেতু এখানে দেশের বিভিন্ন স্থানের লোক এখানে বসবাস করে সেহেতু তারা পরিবার থেকে বাহিরে থাকে। যার ফলে পরিবারে যে স্পেশাল কাউন্সেলিং তা কিন্তু তারা পাচ্ছে না। যখন কেউ বিপদগ্রস্ত হয় তখন তাকে যে আমরা কাউন্সেলিং করি তা কিন্তু তারা পাচ্ছে না। এটা আসলে সমাজের মধ্যে এ ধরনের সমাজ বিচ্ছিন্নতা। যার ফলে সমাজের মধ্যে থেকে সে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে। তারা নিজের হতাশাগুলো শেয়ার করার মত বন্ধু বা স্বজন পাচ্ছে না। যার ফলে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়।
ইএইচ