প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রীর দাপটে গাইবান্ধায় মাটির তৈরির সামগ্রীর কারিগর বা মৃৎশিল্পীদের দুর্দিন চলছে। নেই আগের মতো বেচাবিক্রি। মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, খেলনাসহ অন্যান্য সামগ্রী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগেও কেবল মাত্র দই ও ফুলের টব তৈরি করা হলেও এখন মাত্র দইয়ের পাত্র তৈরি করে কোনো রকমে জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন তারা। তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এ পেশায় সংযুক্ত না করে নিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন পেশায়।
একসময় বিনামূল্যে মাটি পেলেও এখন উচ্চমূল্যে মাটি কিনে এবং অন্যান্য খরচ করে মাটির সামগ্রী তৈরিতে পোষাচ্ছে না তাদের। তারপরও বাবা-দাদার ঐতিহ্যবাহী পৈতৃক এ পেশা ধরে রেখে কোনো রকমে টিকে আছেন তারা।
একসময় দেশের সর্বত্র মৃৎশিল্পী বা কুমারদের সোনালি দিন ছিল। বছরজুড়ে থাকত কুমারবাড়ি বা পালপাড়াতে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট, কলসি, জগ, গ্লাস, গো-খাদ্যের চাড়ি, মুড়ি ভাজার পাতিলসহ নানা আসবাবপত্র এবং বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী তৈরির জমজমাট কর্মযজ্ঞ। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির তৈরি কুমার বা পালদের তৈরি হাঁড়ি-পাতিলসহ নানা সামগ্রী।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ততা নেই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোতে। একটা সময় ওই এলাকার মৃৎশিল্পীরা দিনভর মাটির সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত থাকলেও বর্তমানে কাজ না থাকায় তারা অলস সময় পার করছেন।
জানা যায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে ভারত থেকে এসে বসতি স্থাপন করে কয়েকজন মৃৎশিল্পী। একপর্যায়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। পাঁচ-ছয় ঘর থেকে তারা বর্তমানে শতাধিক ঘর বা পরিবার হয়ে ওঠে ওই পালপাড়ায়। কিন্তু প্রায় ১০ বছর ধরে প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিলসহ অন্যান্য মাটির সামগ্রীর কদর কমে আসে। তিন-চার বছর আগেও কেবল মিষ্টি ও দই এবং ফুলের টবের কিছুটা চাহিদা থাকলেও এখন তাও কমেছে। বর্তমান ওই এলাকায় মাটির তৈরি বিভিন্ন আকারের রিং তৈরি হচ্ছে। ফলে মৃৎশিল্পের প্রকৃত সেই জৌলুস আর নেই।
অবশিষ্ট এখনও যারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত আছে, তারাও মাটি ও বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে সেসব পণ্য তৈরিতেও লাভের মুখ দেখতে পারছেন না। তারপরও বাবা-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছেন তারা। এ পেশা থেকে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অন্য পেশায় নিয়োগ করেছেন।
এ বিষয়ে পাল পাড়ার ধীরেন পাল জানান, একসময় গরুর চাড়ি ও ধান-চাল রাখার মটকা নেয়ার জন্য কৃষকরা পালপাড়ায় এসে বসে থাকতেন। কোনো রকমে কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা এসব জিনিসপত্র নিয়ে যেতেন। আমরাও এসব জিনিসপত্র তৈরি করার সময় পেতাম না। সেসময় আমাদের খুব কদরও ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে আমাদের আর কদর নেই। ঘরের ভেতর ও বাড়ির উঠোনে সারি সারি হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে রাখলেও কেউ নিতে আসে না।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালুয়া বাজারের মাটির হাড়ি পাতিল বিক্রেতা অচিন পাল বলেন, বর্তমানে মাটির তৈরি সামগ্রীর কদর নেই বললেই চলে। মানুষ এখন প্রয়োজনে না শখের বশে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে তা ঘরে সাজিয়ে রাখে। আগে যেখানে বাজারে তিন থেকে চারটি মাটির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান ছিল এখন তা কমে একটি হয়েছে।
গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রবীন্দ্র চন্দ্র রায় জানান, আমাদের পক্ষ থেকে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং মৃৎশিল্লীদের জন্য আর্থিক অনুদান না থাকলেও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। মৃৎশিল্পের প্রসারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের এ সুবিধা দেয়া হবে।
ইএইচ