বরগুনায় সেতু ভেঙে খালে মাইক্রোবাস, ৯ বরযাত্রী নিহত

বেলাল হোসেন মিলন, বরগুনা থেকে প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৪, ০৩:৪৭ পিএম

বরগুনার আমতলী উপজেলা চাওড়া নদীর উপর নির্মিত হলদিয়া হাট ব্রিজ ভেঙে ৯ বরযাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক পরিবারের তিনজন। অপর নিহতরা সকলেই পরস্পর আত্মীয়স্বজন।

এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রিজ নির্মাণ করেছে। ফলে নির্মাণের ৫ বছরের মাথায় ব্রিজের মাঝখানের ভীম ভেঙে যায়। গত ১০ বছর ধরে এ ভাঙ্গা নড়বড়ে ব্রিজের উপর দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করতো। ব্রিজ নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার শাস্তি দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ঘটনা ঘটেছে শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে।

জানা গেছে, আমতলী উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০০৮-০৯ অর্ধ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত চাওড়া নদীর উপর হলদিয়া হাট এলাকায় আয়রণ ব্রিজ নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। ব্রিজের নির্মাণ কাজ পায় তৎকালীন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম মৃধা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ব্রিজ নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রিজ নির্মাণ করেছে।

নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় ব্রিজের মাঝের ভীম ভেঙে যায়। গত ১০ বছর ধরে ওই ভাঙা ব্রিজ দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করে আসছে।

শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে কাউনিয়া ই্ব্রাহিম অ্যাকাডেমির সহকারী শিক্ষক উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহ মনিরের মেয়ে হুমায়রা আক্তারের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমতলী পৌর শহরের খোন্তাকাটা এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহমুদের ছেলে ডা. সোহাগের বিয়ে হয়। শুক্রবার ওই কনেকে বরের বাড়ি তুলে দেন। শনিবার মেয়ের পক্ষের লোকজন বরের বাড়িতে মাইক্রো এবং অটো গাড়িতে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে হলদিয়া ব্রিজ পাড় হওয়ার সময় ব্রিজের মাঝের অংশ ভেঙে যায়। এতে মাইক্রোবাস ও অটো গাড়ি নদীতে পড়ে যায়। অটোতে থাকা যাত্রীরা সকলে সাঁতরে কিনারে উঠতে পারলেও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা নদীতে তলিয়ে যায়।

তাৎক্ষণিক স্থানীয়রা ওই মাইক্রোতে থাকা লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী নাসির উদ্দিন।

খবর পেয়ে আমতলী ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। ততক্ষণে মাইক্রোবাসে থাকা কনে পক্ষের ৯ যাত্রী নিহত হয়েছে।

নিহতরা হলেন রুবিয়া (৪৫), রাইতি (২২), ফাতেমা (৫৫), জাকিয়া (৩৫), রুকাইয়াত ইসলাম (৪), তাহিয়া মেহজাবিন আজাদ (৭), তাসফিয়া (১৪), ঋধি (৪) ও রুবি বেগম (৩৫)।

এদের মধ্যে রুকাইয়াত ইসলাম ও জাকিয়ার বাড়ি উপজেলার দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের। অপর নিহত ৭ জনের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায়। তারা কনে হুমায়রার মামা বাড়ির আত্মীয়স্বজন। নিহতদের লাশ আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে।

খবর পেয়ে বরগুনা-১ আসনের সাংসদ গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব গোলাম সরোয়ার ফোরকান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

মাইক্রোবাসে থাকা সোহেল মিয়া বলেন, মাইক্রোবাসে কনে পক্ষের ১৬ জন যাত্রী বরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে হলদিয়া হাট ব্রিজের উঠামাত্রই ব্রিজ মাঝখান দিয়ে ভেঙে মাইক্রোবাসটি নদীতে পড়ে যায়। আমিসহ ৩ জন সাঁতরে কিনারে উঠতে পেরেছি। পরে স্থানীয়, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম স্বপন ও নাসির উদ্দিন বলেন, মাইক্রোবাস ও অটোগাড়িটি ব্রিজের মাঝখানের আসা মাত্রই ধপাস করে ব্রিজ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক আমরা স্থানীয়দের নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালাই। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।

একই পরিবারের তিন নিহতের স্বজন আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার কিছুই রইলো না। আমার দুই কন্যা ও স্ত্রী মারা গেছে। সব হারিয়ে আমি এখন অসহায়।

হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান মিন্টু মল্লিক বলেন, ব্রিজ নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রিজ নির্মাণ করেছে। ফলে নির্মাণের অল্পদিনের মধ্যেই ব্রিজের মাঝখানের ভীম ভেঙে গেছে। ওই ভাঙা ব্রিজ দিয়ে অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করতো।

তিনি আরও বলেন, এই ভাঙ্গা ব্রিজ মেরামতের জন্য আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বহুবার জানিয়েছি কিন্তু তিনি আমলে নেয়নি। যার ফলে আজ ৯ জনের প্রাণ গেল। ঠিকাদার দায়সারা ব্রিজ নির্মাণ করায় এবং উপজেলা প্রকৌশলী ব্রিজ সংস্কার না করায় তাদের শাস্তি দাবি করছি।

আমতলী থানার ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু বলেন, ব্রিজ ভেঙে মাইক্রোবাস নদীতে ডুবে নিয়ে বিয়ের কনে পক্ষের ৯ জন মানুষ মারা গেছে। নিহতদের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, আমি যথাযথভাবেই ব্রিজ নির্মাণ করেছি। ব্রিজ নির্মাণ কাজে কোনো অনিয়ম করিনি।

আমতলী ফায়ার সার্ভিসের ওয়ার ইনচার্জ মো. হানিফ বলেন, চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে মাইক্রোবাস উদ্ধার করতে পারিনি। উদ্ধার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ব্রিজ ভেঙে নিহত ৯ জনই হাসপাতালে আনার পূর্বেই মারা গেছেন।

আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমতলীতে আমার যোগদানের পূর্বে এ ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছুই জানি না।

আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। উদ্ধার কাজের তদারকি করছি।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ ব্রিজ নির্মাণ যে ঠিকাদার অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

বরগুনা-১ আসনের সাংসদ গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, নিহতের স্বজনদের হাসপাতালে সমবেদনা জানিয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাস্থলে বিক্ষুব্ধ মানুষকে শান্ত করেছি।

তিনি আরও বলেন, ব্রিজ নির্মাণে অনিয়মের কারণে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিহতের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে।

বিআরইউ/ইএইচ/