সিলেটে পুলিশের সব ইউনিটে রদবদল হচ্ছে

শাহজাহান সেলিম বুলবুল, সিলেট প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৪, ০৭:৪৩ পিএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে ঘটে গেছে অনেক কিছু।

এর মধ্যে বড় বিষয় হচ্ছে- জনরোষে পড়েছে দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময় বিশেষ করে সম্প্রতি সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের নির্দেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে হতাহতের ঘটনায় তাদের উপর জনসাধারণের ক্ষোভ প্রবল।

তাই সরকার পতনের পরপরই দেশের বেশিরভাগ থানায় পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ স্টেশনে করা হয়েছে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। অনেক স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে প্রাণ গেছে পুলিশ সদস্যের।

এমতাবস্থায় বুধবার পুলিশের আইজি (মহাপরিদর্শক) সহ শীর্ষ ৪টি পদে হয়েছে রদবদল। কিছু দিনের মধ্যে সিলেটে পুলিশের সব ইউনিটের বেশিরভাগ পদে রদবদল করা হবে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে সিলেট বিভাগে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক পুলিশ অফিসার গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একই স্থানে অবস্থান করছেন। ফলে তারা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মতো হয়ে পড়েছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত।

২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোররাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে সকালে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় মহানগরের আখালিয়া এলাকার রায়হান আহমদ নামের যুবকের। এ ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করা হলেও বিচার কার্যক্রমে রয়েছে ধীরগতি।

সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের বিধি না মেনে সিলেটে নির্বিচারে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়েছেন তারা। সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার এবং হয়রানিও করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার-বাণিজ্য ও থানায় নিয়ে নির্যাতন করাসহ বহু অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

সর্বোপরি ১৯ জুলাই সিলেট মহানগরের বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক এটিএম তুরাব নিহত হন।

৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে নিহত হয় ৫ জন। এদিন আহত আরও দুজন পরে হাসপাতালে মারা যান।

এছাড়া পুলিশের গুলিতে হবিগঞ্জে ১২ ও সুনামগঞ্জে একজন মারা গেছেন। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে আহত হয়েছেন দুই সহস্রাধিক মানুষ। এর মধ্যে রয়েছেন শিশু-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনতা।

মাঠ পর্যায়ের পুলিশরা এসবের দায় দিচ্ছেন ঊর্ধ্বতনদের। পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ ঊর্ধ্বতন অফিসারদের নির্দেশে তারা গুলি চালিয়েছেন। দায় যারই হোক সরকার পরিবর্তনের পর চরম ক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েছেন তারা। সিলেট জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় পুরোটাই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভষ্মীভূত হয়ে গেছে সব কাগজ ও ফাইলপত্র। কার্যালয়ের সামনে থাকা বেশ কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানার এএসআই সন্তোষ সাহা বিক্ষোভকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। এ অবস্থায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভাগের বিভিন্ন থানায় ছিল না পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিলেট রেঞ্জের আওতাধীন ৩৯টি ও মেট্রোপলিটন এলাকার ৬টি থানা এবং ৩টি ফাঁড়িতে জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুর হয়েছে। ৫ আগস্ট রাত থেকে এসব থানা-ফাঁড়ির পুলিশ বিভিন্ন নিরাপদ চলে যান। তবে নতুন আইজিপি’র নির্দেশে পুলিশ সদস্যদের বুঝিয়ে কাজে যোগদান করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বুধবার থেকে সিলেটের কিছু থানায় কার্যক্রম শুরু হয়। বৃহস্পতিবার অধিকাংশ থানায় পুলিশি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়।

বিভিন্ন থানায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র নিরাপত্তায় চলছে কার্যক্রম। তবে বিভাগের অনেক থানা শুক্রবার পর্যন্তও সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে সিলেট সার্কিট হাউসে বৈঠক করেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দিকী (এনডিসি)। এতে বিএনপি, খেলাফত ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা অংশ নেন। পরে বুধবার এসব দলের নেতারা সিলেটের বিভিন্ন থানায় গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের অভয় দিয়ে কার্যক্রম স্বাভাবিক করার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত মেট্রোপলিটন এলাকার ৬টি থানায় কার্যক্রম স্বাভাবিক করা হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ফাঁড়িগুলোতে এখনো কাজ শুরু হয়নি। আর জেলার ১১টি থানার মধ্যে ৬টিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি থানায় সেনাবাহিনী ও ব্যাটালিয়ন আনসার নিরাপত্তায় রয়েছেন।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশ বিভাগকে ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। পুলিশ বাহিনী ও জননিরাপত্তার স্বার্থে প্রশ্নবিদ্ধ জায়গাগুলোতে রদ-বদল করা হবে বলে জানা গেছে। এই ধারাবাহিকতায়  সিলেটে পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজিসহ সব ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রদ-বদল হবে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি বা নির্দেশনা আসেনি।

উল্লেখ্য, রেঞ্জ ডিআইজি (উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক) শাহ মিজান শাফিউর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম) গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি, মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. জাকির হোসেন খান (পিপিএম) ১১ ডিসেম্বর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল মান্নান এ বছরের ১০ জুলাই সিলেটে যোগদান করেন।

ইএইচ