ফেনীর মহিপালে গণহত্যা

‘নিজাম হাজারীর নির্দেশে অস্ত্র দেন যুবলীগ নেতা রফিক-বাবলু’

ফেনী জেলা প্রতিনিধি: প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২৪, ১১:৫৫ এএম

ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে গণহত্যায় অংশ নিতে নিজাম হাজারীর নির্দেশে স্থানীয় পৌর ৪নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি লিটনসহ ৮ জনের হাতে শর্টগান তুলে দেন পৌর যুবলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম ভূঞা ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বাবলু।

এছাড়া সেদিনের হামলায় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গুলি চালিয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) এ গণহত্যায় শহীদ সিহাব হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনার এ বর্ণনা প্রদানকালে এ কথা বলেন।

এর আগে বুধবার (২ আগস্ট) র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন  লিটন। ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েদ মো. শাফায়াত ১৬৪ ধারায় দীর্ঘ ৫ ঘণ্টাব্যাপী তার এ স্বীকারোক্তিমূলক  জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা যায়, লিটন আদালতকে জানিয়েছে- ৪ আগস্ট সকালে সেসহ ৮ জন যুবলীগ নেতা-কর্মী পৌরসভায় আসে। সেখানে আরও ৩শ’ থেকে ৪শ’ দলীয় নেতাকর্মী ছিল।

এসময় ফেনী-২ আসনের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী সবার উদ্দেশ্যে রাখা বক্তব্যে যেকোনো মূল্যে ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। তখন তার পাশে ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল ও পৌর সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী।

এরপর মাস্টারপাড়া থেকে সাদা প্রাইভেটকারের মাধ্যমে ব্যাডমিন্টন ব্যাগে করে কয়েকটি শটগান আনা হয়। পৌরসভার লিবার্টি সুপার মার্কেটের নিচতলায় কৃষকলীগের অফিস কক্ষে লিটনসহ ৮ জনকে ডেকে নিয়ে ৮টি শটগান ও ১০ রাউন্ড করে গুলি দেয় রফিক ও বাবলু। একই সময়  যারা অস্ত্র চালাতে জানতো না তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়।

ওই সূত্র আরও জানায়, মহিপালে হামলার সময় জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও ফাজিলপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মজিবুল হক রিপন, ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন স্থানীয়  উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন মজুমদারকে অনুসরণ করতে অস্ত্রধারীদের নির্দেশ দেয়া হয়।এরপর  ৪০-৫০ জন নেতাকর্মী বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ১শ’ থেকে ২শ’ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহিপালের দিকে যায়।এদের মধ্য থেকে অস্ত্রধারী ও অস্ত্র ছিল না এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নাম আদালতকে জানায় লিটন।

মহিপালে ছাত্র-জনতার উপর গুলি করার সময় নিজে চৌধুরীবাড়ীর মুখে অবস্থান নিয়ে ওপরের দিকে ৮ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলে জানান লিটন। পরবর্তীতে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কৃষকলীগের অফিসে গিয়ে রফিক-বাবলুর কাছে নিজের অস্ত্র জমা দেন দাবি করে বলেন, এসময় ব্যবহার না হওয়া ২ রাউন্ড গুলিও ফেরত দিয়েছেন সে।

সিহাব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাএসআই মো. মোতাহের হোসেন তদন্তের স্বার্থে তিনি অপর জড়িত কারো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।তবে, জবানবন্দিতে লিটনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তদন্ত কাজ চলছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও এ গণহত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত মুরাদ হোসেন বাবু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

৪ আগস্ট মহিপালে গণহত্যায় কলেজ ছাত্র মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় শুক্রবার (৪ অক্টোবর) স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয় এ সংক্রান্তে দায়েরকৃত
মামলায় গ্রেপ্তারকৃত মুরাদ হোসেন বাবু।এসময় গণহত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় সে।জেলার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহানা লোকমান তার এ জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিকালে জেলার সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের মিয়ার বাজার এলাকা থেকে বাবুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭। বাবু ওই ইউনিয়ন যুবলীগের অর্থ সম্পাদক ও  স্থানীয় রসুল আমিনের ছেলে। মাহবুবুল হাসান আন্দোলনরত মাসুম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হওয়ার পর থেকে পলাতক ছিল।

জেলার মহিপালের এ গণহত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত  একাধিক মামলার আইনজীবি মেজবা উদ্দিন ভূইয়া বলেন,  গত ৪ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত গণহত্যার ঘটনা সবার জানা। তবুও ছাত্রলীগ নেতা লিটন ও বাবুর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিচারে সুফল বয়ে আনবে।এছাড়া  বিবেকের তাড়নায় নারকীয় এ গণহত্যাকাণ্ডের চিত্র  অনেক আসামি নিজেদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তুলে ধরবে।

অন্যদিকে এ গণহত্যাসহ হত্যার চেষ্টায় মোট ১৬ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে ৮ টি হত্যা ও ৮টি হত্যার চেষ্টা মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ১টি মামলায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খানসহ প্রতিটি মামলায় ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে আসামি হয়েছেন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওমীলীগের প্রায় ৪৫০০ নেতাকর্মীও আসামি রয়েছেন।  

এদিকে গত বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার তিন দিনে এসব মামলার এজাহারনামীয় ও সন্ধিগ্ধ ৪৫জন আসামিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

ফেনী মডেল থানার ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যহত রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ৪ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আওয়ামী অস্ত্রধারীরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও সিসি টিভি ফুটেজে অস্ত্রধারীরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী জানা গেছে।

বিআরইউ