বৈষম্যের শিকার গাজীপুর সিটির ৭৬ কাউন্সিলর

রফিকুল ইসলাম, পূর্বাচল (গাজীপুর) প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৪, ০৬:৪৭ পিএম

দলীয়ভাবে নির্বাচন না করেও গাজীপুর সিটির ৭৬ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।

প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন বিভিন্ন সময়। ইতোমধ্যে নির্বাচিত কাউন্সিলরেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ন্যায় বিচারের স্বার্থে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রত্যক্ষ হুমকি দিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কাউন্সিলর।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনার পলায়নে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর একযোগে দেশের সবকটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়।

গাজীপুর সিটির প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল। তাকেও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। এখন শুধু অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মোমিন বেতন-ভাতাদিতে স্বাক্ষর করে সিটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকা সচল রাখছেন।

‘মা-বাবা বিহীন’ই রয়ে গেল ঢাকার অদূরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই নগরের বাসিন্দারা। অন্যদিকে গাজীপুর সিটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে পদে পদে, নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। অপসারণ, অব্যাহতি আর ভারপ্রাপ্তের ভারে গাজীপুর সিটির ৫৭ ওয়ার্ডের ৮টি মেট্রোপলিটন থানার ২৬ লাখ মানুষ সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। উন্নয়ন প্রকল্পসহ সব ধরনের কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। নাগরিক সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন জনসাধারণ।  

বুধবার সিটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেবা প্রার্থীদের ভিড়। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। ৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের শুরু থেকে কাউন্সিলরেরা নিয়মিত অফিস করেছেন। যার প্রমাণ চলমান রাখতে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সিটির ৮টি জোনের প্রধানেরা (ম্যাজিস্ট্রেট) মনিটরিং করে তাদের হাজিরা সংরক্ষণ রাখতো ।

জানা যায়, নির্বাচিতদের মধ্যে কেউ কেউ কমপক্ষে ৩-৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিকে ভোটে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেকে মনে করছে সিটির ৮টি জোনের প্রধান কর্মকর্তাদের (ম্যাজিস্ট্রেটদের) দ্বারা ২৬ লাখ জনগোষ্ঠীকে সামাল দেওয়া মোটেও সম্ভব নয়। ৭৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির ১৯ জন ছাড়া অন্য ৫৭ জনের অনেকেরই দলে কোন পদ নাই। বিএনপির যারা পদধারী ছিল তারা নির্বাচনের আগেই সবাই দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ফলে কাউন্সিলরেরা নিজেদের পুরোপুরি স্থানীয় সরকারের নিরপেক্ষ জনপ্রতিনিধি হিসাবে মনে করছেন। তাদেরকে অপসারণ ঠিক হয়নি বলে উচ্চ আদালতে রিট করবেন বলে অনেকেই একমত পোষণ করছেন বলে জানা গেছে।

দেশের সর্ববৃহৎ সিটির ২৬ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী ও প্রায় ১১ লাখ ভোটারের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন। প্রায় ৩৯২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাজীপুর সিটিতে রয়েছে দুটি সরকারি হাসপাতাল, একাধিক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ১০-১২টি বাসস্টেশন, বিভিন্ন ব্যাংকসহ নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসাশিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

একটি সমরাস্ত্র কারখানা, একটি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস (টাঁকশাল), বাংলাদেশ কৃষি ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, দুটি রেলওয়ে জংশন, একটি রেলওয়ে স্টেশন, ২ হাজারের বেশি পোশাক কারখানা, কাজ করেন ২২ লক্ষাধিক শ্রমিক।

তাছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক জোন হিসেবে খ্যাত গাজীপুর সিটি দুর্নীতিবাজদের করাল থাবা থেকে মুক্ত হতে পারেনি প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১১ বছরেও।

সবশেষ জায়েদা খাতুনকে অপসারণ করে ১৯ আগস্ট ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলামকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকার সংস্কারের অংশ হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরবর্তীতে নির্বাচিত ৫৭টি ওয়ার্ডের ৭৬ জন কাউন্সিলরকে অব্যাহতি দেন। সিটির কার্যক্রম শুরুর আগেই নতুন প্রশাসক সাবিরুলকে করা হয় ওএসডি। এখন প্রশাসকের পদশূন্য।

অন্যদিকে ৭৬ জন নির্বাচিত কাউন্সিলরের বিপরীতে ১৭ জন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে স্থলাভিষিক্ত করে সিটি সচল রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিটির ৪১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন মোল্লা বলেন, অফিসের সামনে প্রতিদিন সেবা প্রার্থীদের ভিড় আমাকে হতাশ করছে। এরা যাবে কোথায়? আমাদেরকে অপসারণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। আমি কোন দল করি না।

৩১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিপন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সিটি করপোরেশন নগরভবনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোন সেবা পাচ্ছি না।

সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর হাসনা হেনা বলেন, জনগণের দ্বারে দ্বারে ভোট চেয়ে পাশ করে এখন জনগণের সেবা দিতে পারছি না। যা বড়-ই বেদনাদায়ক। আর প্রতিনিয়ত আমাদেরকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন দায়িত্ব প্রাপ্ত জোনের প্রধান কর্মকর্তারা। তাহলে আমাদেরকে অপসারণের কী প্রয়োজন ছিল?

এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, নাগরিক সেবা শুধু ব্যাহত নয়, পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মোমিন শুধু বেতন-ভাতাদিতে স্বাক্ষর করে আমাদেরকে সচল রেখেছেন।

ইএইচ