কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যের ইতিহাস ‘এগারসিন্দু প্রাচীন দুর্গ’

পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি: প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০১:০২ পিএম

ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ জেলাটির সাথে ঈসা খান নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তার বহু স্থাপনা এই জেলায় আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তেমনি একটি স্থাপনা হল ঈসা খানের নাম বিজড়িত মধ্যযুগীয় একটি দুর্গ যা এগারসিন্ধুর দুর্গ (Egarosindur Fort) নামে অধিক পরিচিত।

কিশোরগঞ্জ থেকে ২২ কিলোমিটার এবং পাকুন্দিয়া উপজেলা হতে ৮ কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দু গ্রামে এর অবস্থান। এগারোসিন্ধুর নামের পূর্বে জায়গাটি গঞ্জের হাট নামে পরিচিত ছিল। ১১ টি ছোট বড় খাল বা নদী এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পরবর্তীতে এই জায়গা এগারসিন্দুর নামে পরিচিতি পায়।

ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত এগারসিন্দুর দুর্গের মূল নির্মাতা হিসাবে রাজা আজাহবা, কোচ হাজং উপজাতি প্রধান বেবুধ রাজা ও রাজা গৌর গোবিন্দ এই তিনজনকে নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। তবে আশেপাশে ‍বেবুধ রাজার দীঘিসহ বিভিন্ন স্থাপনার কারণে এ দুর্গের নির্মাতা হিসাবে তাঁর নামই বেশী প্রচলিত। সুলতানী আমলের পর এগারসিন্দুর এলাকাটি বেবুধ রাজার দখলে চলে যায়। এখানে পুরোনো একটি দিঘিও রয়েছে যেটিকে ‘বেবুধ রাজার দিঘি’ বলা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় এ দিঘির পাড়েই মূলত রাজপ্রাসাদটি অবস্থিত ছিল।

পরবর্তীতে বাংলার বার ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁ বেবুধ রাজাকে পরাজিত করে এগারসিন্দুর দুর্গটি দখল করেন। মোঘল সেনাপতি রাজা দুর্জন সিংহ এবং ইতিহাস আলোচিত মান সিংহের লড়াই এ জায়গাতেই ঘটেছিল। কথিত আছে, ১৫৯৮ সালে ঈশা খাঁ সাথে যুদ্ধে মান সিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে যায় তখন নিরস্ত্র মানসিংহকে ঈশা খাঁ নতুন অস্ত্র তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেন। ঈসা খাঁর এই মহানুববতায় মান সিংহ পরাজয় মেনে নেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কারণে দুর্গটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে দুর্গের ভেতরে উঁচু ঢিবি দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে কামান দাগানো হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

এছাড়াও এগারসিন্ধুর দুর্গে আশেপাশে ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে যেগুলো একটু নজর দেয়া যায়—

শাহ্ মাহমুদ মসজিদ

এগারসিন্দুরের একটি প্রাচীন স্থাপত্য হচ্ছে শাহ্ মাহমুদ মসজিদ ও বালাখানা। গবেষকদের মতে এটি ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়। বর্গাকৃতির এ মসজিদটির প্রত্যেক বাহু ৩২ ফুট। চার কোণায় ৪টি বুরুজ রয়েছে। রয়েছে একটি বিশাল গম্বুজ। দু’পাশে দুটি সরু মিনার রয়েছে। ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মেহরাব আছে। শাহ্ মাহমুদ এ মসজিদ ও বালাখানা নির্মাণ করেছিলেন বলে এর নামকরণ হয় শাহ্ মাহমুদ মসজিদ।

সাদী মসজিদ

এখানে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয় সাদী মসজিদ। পোড়ামাটির অলংকরণে সমৃদ্ধ এ মসজিদটি সম্পূর্ণ ইটের তৈরি। এটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতি মসজিদ। প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট। চারপাশে চারটি বুরুজ। পূর্ব দেয়ালে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। প্রবেশ পথগুলোর চারদিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের কাজ রয়েছে। ভিতরে ৩টি অনিন্দ্য সুন্দর মেহরাব রয়েছে যা টেরাকোটার দ্বারা অলংকৃত। ১০৬২ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে শাহজাহান বাদশা গাজীর রাজত্বকালে শেখ নিরুর পুত্র সাদীর উদ্যোগে এ মসজিদটি নির্মিত হয় বিধায় এর নামকরণ হয় সাদী মসজিদ।

বেবুদ রাজার দীঘি

এগারসিন্দুরের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে বেবুদ রাজার দীঘি অন্যতম। বেবুদ নামে হাজং রাজা বাস করতেন এখানে। একবার প্রচণ্ড খরা দেখা দেয়ায় রাজা প্রজাদের কল্যাণে পঞ্চাশ একর জমি বিস্তৃত একটি দীঘি কাটলেন। কিন্তু পানির নাম গন্ধ নেই। এরই মধ্যে রাজা স্বপ্নে দেখেন তার রাণী যদি দীঘিতে নামে তবে পানি উঠবে। স্বপ্নের কথা রাজা রানীকে জানালে প্রজাদের মুখের পানে চেয়ে রাণী দীঘিতে নামতে রাজি হলেন তাতে রাজাও খুশি হলেন এবং পরদিন রাণী এক বাটি কাঁচা দুধ, পান সুপারি ও সিঁদুর নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দীঘিতে নামলেন। সাথে সাথেই দীঘির চারপাশ থেকে স্বচ্ছ জল এসে দীঘি ভরে গেল কিন্তু রাণী আর দীঘি থেকে উঠতে পারলেন না।

চোখের পলকে রাণীর কেশগুচ্ছ বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে নিমজ্জিত হয়ে গেল। রাজা রাণীর জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেলেন। দীঘিটি গভীর থাকায় পানি খুবই স্বচ্ছ দেখায়। বেবুদ রাজা দীঘিটি খনন করেন বিধায় তার নামানুসারে এ দীঘিটি বেবুদ রাজার দীঘি নামে পরিচিত। এ দীঘির পানিতে গাছের পাতা কিংবা অন্য কোন কিছু পড়ে থাকলে তা পরদিন সকালে পাড়ে এসে জমা হয়। লোকমুখে শোনা যায়, কোন অনুষ্ঠানের জন্য দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থালা, বাসন ও অন্যান্য তৈজসপত্র চাইলে পরদিন দীঘির পাড়ে পাওয়া যেত। তবে শর্ত ছিল যা যা নেয়া হত তা সঠিকভাবে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু একদিন কেহ এ শর্ত ভঙ্গ করায় এরপর থেকে তৈজসপত্র আর পাওয়া যায় না।

কীভাবে যাবেন:

ঢাকার মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে জলসিঁড়ি ও অনন্যা পরিবহনের বাস পাকুন্দিয়া হয়ে চলাচল করে। থানার ঘাট নামক জায়গাতে বাস থেকে নেমে রিকশা বা ইজিবাইকে খুব সহজেই এগারসিন্দুর যাওয়া যায়।

ঢাকা থেকে ট্রেনে আসতে হলে আপনাকে আন্তঃনগর ট্রেন এগারোসিন্দুর কিংবা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে চড়ে মানিকখালী স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে ইজিবাইক বা সিএনজিতে করে আসতে হবে কটিয়াদী। কটিয়াদী থেকে সরাসরি এগারোসিন্দুর যেতে পারবেন।

বিআরইউ