মাদক সেবন করে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হলেও কারবারিরা থাকেন বীরদর্পে।ক্ষমতার পালবদলেও টনক নড়ে না তাদের।ফলে সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা থেকে মেলে না মুক্তি।ঠিক তেমনি গাজীপুরের কাশিমপুরের ৬নং ওয়ার্ডের নয়াপাড়া এলাকায় ২০ মাদক কারবারির কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে আছেন স্থানীয়রা।
এসব মাদক কারবারিরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ফুলেফেঁপে হয়েছেন কোটি কোটি টাকা ও বাড়ি-গাড়ির মালিক। অপরদিকে মাদক সেবন করে গত ১০ বছরে ভিটে-মাটি হারা হয়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার।এমনকি মারা গেছে ১২-১৫ জন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং থানা পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করেই চলত এসব মাদকের ব্যবসা।বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে এবং আগের পুলিশ না থাকলেও মাদক কারবারিরা রয়েছেন বীরদর্পে।
জানা যায়, কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা লিপি বেগম কাজ করতেন মানুষের বাসায়।বসতভিটার জমিও ছিল না তার।এদিকে তার মা আনোয়ারা বেগম লেবু বিক্রি করতেন। এখন ছয় তলা বাড়িসহ কয়েকটা টিনশেড বাড়ির মালিক। ১০ বছরের ব্যবধানে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক। পুলিশের সোর্স পরিচয় দেওয়া লিপির স্বামী ফরিদ আটটি বিয়ে করেছেন। ঘুরে বেড়ান দামি মোটরসাইকেলে। এছাড়াও মাদক কারবারি বাদশা ও সমলা তিনতলা এবং বাতেন দোতলা বাড়ির মালিক হয়েছেন।ওই এলাকায় মাদকের বড় ডিলার স্থানীয় যুব মহিলা লীগ সাধারণ সম্পাদক নেত্রী ডালিয়া বেগম।তিনিও ৩-৪ বছর আগে মানুষের বাসায় কাজ করতেন এবং তার স্বামী ওয়াসিম রিকশা চালাতেন।এখন ১০-১২ জন লোক রেখে তারা মাদক বিক্রি করেন।বর্তমানে তারা পাঁচটি বাড়ির মালিক।
এছাড়াও মাদকের বড় কারবারিরা হলো-ডালিয়ার ভাই রহজুদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর, হাছেন আলীর ছেলে আশু,মৃত মনির উদ্দিনের ছেলে জীবন, তার মা মরিয়ম বেগম, আবদুল কসাই কসাইয়ের ছেলে রিপন, সবুজ, শিল্পী ও লিপি, রহম আলীর ছেলে জাকির, জাকির স্ত্রী সমত বানু, নুরু ছেলে আলমগীর হোসেন, ডালিয়ায় বোন শিপন, বাবুল মিয়ার ছেলে বাবলি ও হোসেন আলীর ছেলে খোরশেদ।মাদকের কারবারিরা রাতারাতি কোটিপতি হয়ে প্রভাব বিস্তার করে চলাফেরা করেন।স্থানীয়রা মাদক কারবারের প্রতিবাদ জানালে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।এদের বিরুদ্ধে গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় মাদকের মামলা থাকলেও কিছু দিন জেল খেটে ফের মাদকের কারবারে নেমে পড়েন।পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানেও থামছে না এসব মাদক কারবারিরা। মাদক কারবার করে তারা হয়েছেন কোটিপতি আর সেবন করে অনেকে হয়েছেন ঘর-সংসার ছাড়া। ভিটে-মাটি বিক্রি করে বসেছেন পথে।আর অকালে হারিয়েছে জীবন।
সরেজমিনে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে,গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর নয়াপাড়ায় ২০ মাদক ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে জিম্মি এলাকার লাখ লাখ মানুষ। মাদক সেবন করে গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের।তারপরও বন্ধ হয়নি মাদক,বরং বেড়েছে।মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে হামলা-মিথ্যা মামলা।
স্থানীয়রা বলেন,কাশিমপুর নয়াপাড়া গ্রামের রওশন মার্কেট সংলগ্ন কাঁঠালতলা মহল্লায় ২০ মাদক কারবারি সিটি করপোরেশনের ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর কাশিমপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান তুলা ও একই ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমির হোসেনের সহায়তায় মাদক কারবার করে চলেছেন।৫ আগস্টের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে মাদক কারবার।মাঝেমধ্যে মাদক কারবারিরা ধরা পড়লেও সহায়তাকারী নেতারা ছাড়িয়ে আনতেন।কিন্তু ৫ আগস্টের পর আসাদুজ্জামান তুলা পালিয়ে বেড়ালেও তার সহযোগীরা বীরদর্পে চলাফেরা করছেন।
এসব মাদক কারবারিদের মধ্যে লিপি বেগম,ডালিয়া বেগম ও ওয়াসিমের সঙ্গে কথা বললে তারা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ফোন কেটে দেন।মোবাইল ফোনে কথা বলতে অস্বীকার করেন।
লিপির চাচাতো বোন কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকার শেফালী আক্তার গুলু জানান, মাদক কারবারিদের কাছে এলাকা জিম্মি। তার তিন ভাই আয়নাল হক,মনির হোসেন ও গোলজার হোসেন মাদক খেয়ে অকালে মারা গেছেন। ভাইদের মৃত্যুর পর তিনি মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।এ কারণে মাদক কারবারিদের টার্গেটে পরিণত হন তিনি। গত কয়েক মাস আগে তিনি ও ছেলে এবং ছোট বোন মাদক কারবারিদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। দোকানে মাদক রেখে ফাঁসাতে চেয়েছে। জুলাইয়ের শেষে ছেলে সোহানকে কুপিয়েছে। ছোট বোন লিপি আক্তার ও তার ওপর হামলা হয়েছে।শতাধিক লোকজন নিয়ে ছেলের উপর হামলা করে।এখনো মামলা নেয়নি পুলিশ। কাউন্সিলর ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেয়, চিকিৎসা করেন। ওদের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছে শুনেছি।
জানা গেছে,গত ৯-১০ বছরের ব্যবধানে গুলুর তিন ভাই ছাড়াও মরিয়মের সাবেক জামাই মনির হোসেন, জসিম ওরফে জসি, সবুজ, নুরুল ইসলাম, খোরশেদ, শাহজাহান, আসকর আলীও ইছু মিয়া মাদক সেবনে মারা গেছেন।
স্থানীয় অরচার্ড পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কমার্স কলেজের প্রধান শিক্ষক দুলাল হোসেন বলেন,মাঝে মধ্যেই মাদক পল্লীতে অভিযান হয়। কয়েক দিন বন্ধ থাকে।আবার শুরু হয়।এভাবেই ১৫-১৬ বছর ধরে চলে আসছে।মাদক কারবারিরা শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দেয়।দলবেঁধে হামলা করে। ওদের টাকার পাহাড়। নির্যাতনের শিকার হতে হয়।জনপ্রতিনিধিরা ভোটের আগে নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়।পরে ভোটের রাজনীতির জন্য চুপ থাকে।
এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী জানান,তার ছেলে আওলাদ সিএনজি চালাতেন। সিগারেটও খেতেন না।দেড় বছর আগে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন।দেড় মাস ধরে জেলে। জামিনের চেষ্টা করেন না।
স্থানীয়রা আরোও বলেন,কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় এখন কোনো মানুষ বিয়ের জন্য আসে না।সবাই জানে এ এলাকার সব লোকজন মাদকের সঙ্গে জড়িত।এখানে হাত বাড়ালেই মাদক মিলে সবসময়।
মাদকের বিষয়ে কাশিমপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সবসময় চলমান। ওই এলাকায় বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার ও মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদক নির্মূলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। আর পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বিআরইউ