‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে যখন মুখরিত ঢাকার রাজপথ, তখন পুলিশের গুলিতে রক্তে রঞ্জিত হয় পীচ-ঢালা পথ। সালাম, রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে।
ওই দিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবদুল জব্বার। আবদুল জব্বার ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামের বাবা হাসান আলী এবং মাতার নাম সাফাতুন নেছা দম্পত্তির ছেলে ছেলে। তিনি ১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর ওই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষ্টবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর লেখাপড়া করেন। তবে, সংসারের অভাবের কারণে বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করেন।
আবদুল জব্বারের ছেলে সন্তান জন্ম হওয়ার কিছুদিন পরে তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় যান। হাসপাতালে তার শাশুড়িকে ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী সিরাজুল ইসলামের রুমে উঠেন।২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আসলে জব্বার তাতে যোগদান করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে এবং জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জেলার গফরগাঁও উপজেলায় ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি ১৭ বছরেও পূ্র্নতা পায়নি। গ্রন্থাগারে ৪ হাজার ১৭৬ বই থাকা সত্ত্বেও জাদুঘরটিতে নেই শহীদ আবদুল জব্বারের ব্যবহারে কোন জিনিসপত্র। চলাচলের রাস্তাটিরও বেহাল অবস্থা। বছরের একটা দিন ছাড়া অন্য সময় থাকে দর্শনার্থী শূন্য। স্থানটিকে আকর্ষণীয় করার দাবি স্থানীয়দের। কর্তৃপক্ষ বলছে, দর্শনার্থী বাড়াতে নেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা।
জানা যায়, গফরগাঁও উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে রাওনা ইউনিয়নের পাঁচুয়া গ্রামে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের গ্রামের বাড়ি পাঁচু্য়া ছিল না কোন শহীদ মিনার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে ২০০৩-৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে গফরগাঁও উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান সুলতানের পরিকল্পনায় জেলা যুবদল নেতা মুশফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ও স্থানীয় লোকজন কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে একুশে ফেব্রুয়ারি উৎযাপন শুরু করে।
পরবর্তী সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান সুলতানের চেষ্টায় সরকারিভাবে ২০০৫ সালে ভাষা শহীদের গ্রামের স্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শহীদ জব্বার রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারি করণ করা হয়।
ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের নামে ২০০৮ সালে তারই জন্মস্থান ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের রাওনা ইউনিয়নের পাঁচুয়াতে প্রতিষ্ঠা হয় ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। সেই সাথে গ্রামের নামকরণ করা হয় জব্বার নগর। এর পর ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পূর্ণতা পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। পর্যাপ্ত পরিমাণ বই, ভাষা শহীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, পত্রিকা, ইন্টারনেট না থাকায় দিন দিন কমছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। ফাঁকা পড়ে থাকে গ্রন্থাগারের টেবিল চেয়ার গুলো। ফেব্রুয়ারিতে দূরদূরান্ত থেকে আসা কিছু দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বছরের অন্যান্য সময় এখানে থাকে দর্শনার্থী শূন্য। ১৭ বছরে ও হয়নি ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের নামে জব্বার নগরের গেজেট।
সারা বছর সরব না থাকলেও ভাষার মাসে লাখো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় পাঁচুয়ার শহীদ আব্দুল জব্বারের জন্মস্থান জব্বারনগরে। এখানে সরকারি পর্যায়ে উদযাপিত হয় অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা। তবে দুঃখজনক বিষয় চার হাজার একশত ছিয়াত্তরটি বই সংগ্রহ নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা গ্রন্থাগার ও জাদুঘর অলস হয়ে পড়ে আছে। বিশাল হলরুমে চেয়ার টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে যায় কিছু দর্শনার্থী। ছুটির দিন বাদে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর। নতুন প্রজন্মের কাছে শহীদদের আত্মত্যাগের কথা, তাদের জীবনী এবং স্মৃতি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিবে রাষ্ট্র, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় ও দর্শনার্থীদের।
স্থানীয় জহিরুল ইসলাম মিন্টু বলেন, গত ১৭ বছর গ্রন্থাগারটি জনবান্ধব করে গড়ে তুলা হয়নি। এখানে ইন্টারনেট সেবা নেই, পত্রিকা বন্ধ এছাড়াও জব্বার নগর নামে নামকরণের গেজেটে অন্তর্ভুক্তা করা হয়নি।
গফরগাঁও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিকুর রহমান বলেন, অনেক আন্দোলন করে এবং কয়েক বছর কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে উদ্যাপন করার পর ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের বাড়িতে শহীদ মিনার ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি যে ভাবে পাঠকরা আকৃষ্ট হয় সেই পরিকল্পনা নেওয়া, দ্রুত এলাকার নামকরণ জব্বার নগর গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভাষা শহীদের নামে শহীদ আবদুল জব্বার কারিগরি কলেজ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার বলেন, ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির সংস্কার চলছে। বাকি সংস্কারের জন্য নেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা।
বিআরইউ