প্রতিশোধ ও প্রভাব বিস্তার করতেই ৩ ভাইকে খুন

জাহিদ হাসান, মাদারীপুর প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম

নিহত সাইফুল সরদার ছিলেন মাদারীপুরের খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এই পদ ব্যবহার করে এলাকায় হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। নিজের চাচা হোসেন সরদারকে গেল বছর হাতুড়ি পেটা করে পঙ্গু করে দেন। হোসেন সরদারও ছিলেন আওয়ামী লীগের লোক। সরকার পতনের পর বালু সিন্ডিকেট টিকিয়ে রাখতে সাইফুল বিএনপি নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। 

স্থানীয় হাটের ইজারা নেন সাইফুল। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে হোসেন সরদার প্রতিশোধ নিতে সাইফুলের প্রতিপক্ষদের সংঘবদ্ধ করে শনিবার দুপুরে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে সাইফুলসহ তিনজন নিহত হয়। এ ঘটনায় শনিবার (৮ মার্চ) রাতে মাদারীপুর সদর থানায় নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে হোসেন সরদারকে প্রধান আসামি করে ৪৯জনের নামে মামলা দায়ের করেন।  ঘটনার পরে এলাকায় বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সরদার। গেল বছর মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর এলাকার বালু ব্যবসায়ী হোসেন সরদারকে (৬০) প্রকাশ্যে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেয় সাইফুল সরদার। এলাকায় সালিশ মিমাংসায় প্রভাব বিস্তার করতেন সাইফুল সরদার। অভিযোগ রয়েছে মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা ও প্রভাব বিস্তার করে হাটের ইজারা নিয়েছিলেন সাইফুল। এলাকায় হিটার সাইফুল হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। মাদারীপুর সদর থানায় এসব ঘটনায় ৭টি মামলা হয়েছিল সাইফুলের বিরুদ্ধে। এসব মামলা হলেও কিছুদিন জেল খেটে আবার শুরু করতেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এসব কারনে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন সাইফুলের উপর। এই সব ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই হোসেন সরদারের নেতৃত্বে সাইফুল গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান। শনিবার (৮ মার্চ) সাইফুল (৩৫) ও তার ভাই আতাউর সরদার (৪০)এবং চাচাতো ভাই পলাশ সরদারকে (১৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল জেলা আওয়ামী লীগ। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এবং অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম। নিহত সাইফুল বাহাউদ্দীন নাসিম সমর্থিত খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আর তার প্রতিপক্ষ অভিযুক্ত হোসেন সরদার (৬০) ছিলেন শাজাহান খান সমর্থিত আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট ও খোয়াজপুর-টেকেরহাট বাজারের ইজারা দখল নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খোয়াজপুর বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হোসেন সরদারের দুই পা ভেঙে দেন সাইফুল সরদার ও তার লোকজন। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। ৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাইফুল বিএনপি নেতাদের সাথে সখ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় স্থানীয়রা। পরে পা ভাঙার প্রতিশোধ ও পুরো সিন্ডিকেট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন হোসেন সরদার। এ নিয়ে মাসখানেক আগে দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা ভাংচুরেরও ঘটনা ঘটে। 

একপর্যায়ে শনিবার (৮ মার্চ) হামলা চালিয়ে সাইফুল ও তার ভাই আতাউর সরদারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে হোসেন সরদারের লোকজন। একই সঙ্গে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় নিহত সাইফুলের আরেক ভাই অলিল সরদার ও চাচাতো ভাই পলাশ সরদার(১৫) সহ আরো ৮ জনকে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে প্রেরণ করলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় পলাশ সরদারের মৃত্যু হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত সাইফুলের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, এক সময় এলাকায় খুব প্রভাব ছিল সাইফুলের। বিভিন্ন বিচার শালিসিও করতেন তিনি। মানুষ তার কথা মানতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। হোসেন সরদারও তখন আওয়ামীলীগে ছিলেন। সম্প্রতি সাইফুল তার লোকজন নিয়ে হোসেনের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে তার লোকজনকে মারধর করে। হোসেনের লোকজন আবার সাইফুলের এক মামাকে তুলে নিয়ে মারধর করে। সেই ঘটনা মাসখানেক আগে মিমাংসাও হয়ে গেছে।

নিহত সাইফুলের স্ত্রী জানান, আমার আমার স্বামী কারো খারাপ চাইত না। ড্রেজারের ব্যবসা করতো। সরকারের কাছ থেকে হাট ইজারা নিয়েছিল। আমাদের হাট ঘাট ব্যবসা বাণিজ্য দখল করে নেয়ার জন্য হত্যা করেছে। আমার স্বামী ব্যবসা করে আর ওরা টাকা পয়সা নিয়ে যায়। গত বছর আমার স্বামীর সাথে হোসেন সরদারের একটা বিরোধ হয়েছিল। সেই ক্ষোভ ধরেই হোসেন সরদার তার নিজের জমি ৭-৮ লাখ টাকা বিক্রি করে এলাকার সমস্ত লোকজন নিয়ে রান দা, সেনদা-অস্ত্রশন্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে, সামনে দিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। আমরা পালানোর চেষ্টা করি। পরে আমাদের বাড়ি ঘট লুটপাট করে প্রথমে তারপর আগুন দিয়ে দিয়েছে। পরে আমার স্বামীসহ আমার দুই ভাই মসজিদে গিয়ে পালিয়েছে। তখন আমার স্বামী ও ভাশুর আতাউর সরদারকে মাইর‍্যা ফালাইছে। আরেকটা ছোট ভাই পলাশ তাকেও মাইর‍্যা ফালাইছে। নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বলেন, ওরা মানুষ ভাড়া করে অস্ত্র এনে আমার ছেলেরে মারতে আসছে। পরে আমার ছেলেও মারামারিতে জড়ায়। বোমা মেরে আমার ছেলেকে ধাওয়া করে। প্রাণ বাঁচাতে মসজিদে আশ্রয় নেয়। সেখানে কুপিয়ে দুই ছেলেকে হত্যা করে। আমার ছেলে ছিলো অনেক ভালো মানুষ। ওদের কথা শুনেনি তাই আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলের বালু ব্যবসার টাকা, হাট ইজারার টাকা ওরা দিতো না। এসব নিয়েই আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমরা এর বিচার চাই।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বালু ব্যবসা ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই ঘটেছে। এই মামলার ভিকটিম সাইফুল তার বংশীয় চাচা হোসেন সরদারকে পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দেন। সেই ঘটনায় মামলা হলে জেলা পুলিশ সাইফুলকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। মূলত বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। 

আরএস