চৌগাছায় দেশের প্রবীণ শিক্ষক আয়ুব হোসেনের বাড়ি ফলমূল নিয়ে ইউএনও

এম এ মান্নান, চৌগাছা (যশোর) প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ০৭:৫৬ পিএম

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আয়ুব হোসেন। নিজের বয়স দাবি করেন ১২১ বছর। শতবর্ষী দেশের প্রবীণ এই শিক্ষক এখনও নিজে পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে চৌগাছা শহরে পত্রিকা কিনতে যান। যান অফিসে। ব্যাংকে যান নিজের পেনশনের টাকা তুলতে। খালি চোখে চশমা ছাড়াই পত্রিকা পড়েন। ৩ ছেলে ও ৭ মেয়ের জনক আয়ুব স্যারকে সবাই আয়ুব মাস্টার বলেই চেনেন। চৌগাছা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হুদাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি। 

শতবর্ষী এই শিক্ষকের সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতিবার(১০ এপ্রিল) বিকেলে কিছু ফলমূল উপহার নিয়ে স্যারের বাড়িতে হাজির হন চৌগাছার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা ইসলাম। সাথে ইউএনও অফিসের স্টাফ শাহজালাল। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী (আনসার সদস্য) ও গাড়ি চালক।

নিজ বাড়িতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পেয়ে  আইউব স্যার আনন্দে আত্মহারা। নিজের জীবনের গল্প, স্ত্রীর গল্প বলে চলেন এক নিঃশ্বাসে। ইউএনওকে বলেন তোমার বৌমা (পুত্রবধূ) বেচে থাকলে খুব খুশি হতেন। বলে চলেন নিজের ছেলে মেয়েদের কথা। কোন অভিযোগ নেই স্যারের। সব বিষয়েই পজেটিভ। একটা কথা বলেন আর শিশুর মতো হাসেন। বলেন মাস শেষে বেতন পেলে (পেনশন) যদি বৌমা‍‍`কে এক হাজার টাকা দিই তাহলে পুতনিরা (বড় ছেলের মেয়েরা) এসে বলে দাদু আমাকেও দাও। বলেন আর হাসেন। নির্মল হাসি। 
ইউএনওকে বাড়ি থেকে (বড় ছেলের দোকান) চা খাওয়াবেন বলে জেদ ধরেন। অগত্যা স্যারের কথা শিরোধার্য মেনে ইউএনও রাজি হন চা খেতে। স্যারের আনন্দ আর ধরেনা। নিজে হাতে চায়ের কাপ তুলে দেন ইউএনওর হাতে। বিদায়ের সময় বলেন মা আবার এসো। তোমার বৌমা থাকলে কত যত্ন করতো? এবার এসে ভাত খেয়ে যেতে হবে। 

ইউএনও স্যারকে বলেন আপনি চৌগাছায় গেলে আমার অফিসে অবশ্যই যাবেন। স্যার রাজী হন। 

চৌগাছা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েক প্রজন্মের স্যার। কারো বাবার স্যার, কারও দাদার স্যার। এজন্য তিনি সকলের স্যার। 

জানালেন কোলকাতা থেকে লেখাপড়া করে শিক্ষকতা পেশায় যোগদেন। ব্রিটিশ আমলে যখন শিক্ষকতায় যোগদেন তখন ১৭টাকা বেতন ছিলো। জানালেন তাতে ভালোই চলতো। এরপর পাকিস্তান তারপর বাংলাদেশ। তিন যুগেই তিনি শিক্ষক ছিলেন। জানালেন তখন এক টাকা মানের রৌপ্যমূদ্রায় বেতন পেতেন।
তার ছাত্র মরহুম একে শফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বর্তমান চৌগাছা সরকারি শাহাদাৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনিও অবসরে যান ২০০৪ সালের দিকে। তিনি মারাও গেছেন ২০১২ সালের দিকে। তার কাছে সরাসরি পড়েছেন এমন ছাত্র বেশিরভাগই মারা গেছেন। যারা আছেন তারাও বয়োবৃদ্ধ। তার কাছে শিক্ষা পেয়ে বহু জ্ঞানী, গুণী ও দেশের প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক, শিল্পপতি,রাজনৈতিক নেতা  হয়েছেন অনেকে। 

জানা যায় ৭১‍‍` র মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা  শার্শার বাহাদুরপুরের রফিউদ্দীন দীর্ঘ ৯ মাস মাস্টার আয়ুব হোসেনের বাড়ি আশ্রয়ে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেয়াটা তার পক্ষে ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ, তার বাড়ি আড়াই কিলোমিটার দুরে চৌগাছা ডাকবাংলোতে ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। অন্য আর একদিকে দিকে দেড় কিলোমিটার দুরে ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। মধ্যবর্তী স্থানে থেকে মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেয়া ছিল তার পক্ষে জীবনমরণ সমস্যা। 

ঘটনা জানাজানি হলে তিনি বিপদ আঁচ করতে পারেন এবং নিজের বড় কন্যা সুফিয়া খাতুনকে ওই রফিউদ্দিনের সাথে বিয়ে দেন। এরপর প্রচার করতে থাকেন তার মেয়ে জামাই। ঘরজামাই রয়েছে। পাকহানাদার বাহিনী একবার তার বাড়ি হানা দিয়েছিল। তখন গ্রামবাসী একযোগে বলেছিলেন এখানে মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। যে লোক থাকে, সে লোক ( রফিউদ্দিন) তার মেয়ে জামাই। সেদিন পাকসেনারা ফিরে যায়। পরের তারিখে মাসিলা থেকে চৌগাছায় যাওয়ার পথে মাস্টার আয়ুব হোসেনর বাড়ি হানা দেয়।

আরএস