অর্থনৈতিক সংকট আর বাড়বে না: গভর্নর

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৩, ০৮:৪৬ পিএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, করোনা ও যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে আর্থিক সংকট যতটুকু তৈরি হওয়ার তা হয়েছে; এটি আর বাড়বে না।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন গভর্নর। ডলার মার্কেট নিয়ে গভর্নর বলেন, কয়েকমাস আগে ডলার সংকট প্রবল হয়ে উঠেছিল। কারণ তখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় প্রায় দ্ইু হাজার ৪০০ মিলিয়ন বেশি ছিল। 

তাই আমাদের প্রথম টার্গেট ছিল আমদানি কমানো। এটা  যাতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সমান হয়। এ টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ওভার  ইনভেয়েসিং ও আন্ডার ইনভেয়েসিং হয়েছে কিনা সেটা দেখেছি। 

এর মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে আমদানি কমে এসেছে। এখন দেখা যাচ্ছে আমদানির তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। ফলে ডলারের যে চাপ ছিলো সেটা অনেকটা কমে এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তবে এর প্রভাব রমজানের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর পড়বে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সে আলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সময়ে কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ব্যাংক সমস্যায় পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করে। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় এ সহায়তা দেয়া হয়। তিনি উদহারণ দিয়ে বলেন, বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকে সাধারণ মানুষের আমানত রয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকটিতে ১ কোটি ৯০ লাখ একাউন্ট রয়েছে। এখানে শেয়ার হোল্ডারের চেয়ে বেশি টাকা রয়েছে সাধারণ মানুষের। ব্যাংক সমস্যায় পড়লে এসব মানুষের ক্ষতি হবে। তাই সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের চিন্তা করেই এ সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটিকে যে টাকা দেয়া হয়েছে, তাতে কোনো রিস্ক নেই।

কারণ ইসলামি ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা সাধারণ ব্যাংকিংয়ের তুলণায় অধিক নিরাপদ। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরাতো কাউকে রাতারাতি ধরে আনতে পারি না। ইতোমধ্যে দুইটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি চার-পাঁচ মাসের মধ্যে ইসলামি ব্যাংকের সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ব্যাংকও বন্ধ হয়নি। ব্যাংক সমস্যায় পড়লেও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করতে দেয়নি। কারণ ব্যাংকগুলো জনগণের আমানত রয়েছে। জনগণের কথা চিন্তা করেই ভিন্ন ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠির চাপে রয়েছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো চাপে নেই। এটা প্রথম দিনেই বলেছি। আমি এরচেয়ে চাপের জায়গায় থেকে কাজ করে এসেছি। সুতারং কোনো চাপ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে। নিয়মের বাইরে কাউকে এলাউ করা হয় না।

কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবাইকে গ্রাহক হিসাবে দেখে। এটা প্রত্যেকটা ব্যাংকে জানিয়ে দেয়াও হয়েছে। কে কয়টি ব্যাংকের মালিক সেটি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আমরা চাই তারা ব্যবসা করুক। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হোক। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেউ অনিয়ম করলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না।  

ব্যাংকগুলোর ডলারের অনিয়মের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ১২টি ব্যাংক ডলারের দাম বৃদ্ধি করে দুই মাসে এক হাজার ৩৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। আমরা একে অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

তাদের প্রফিটের অর্ধেক সিএসআর ফান্ডের দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি বাকি টাকা কৃষি সিএমএসএমইসহ তিনটি অগ্রাধিকার খাতে ব্যয় করতে বলা হয়ে। যেহেতু এই টাকা জনগনকে ঠকিয়ে আয় করা হয়েছে, তাই আমরা চাই এটি জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হোক।

গভর্নর বলেন, চলমান মূল্যস্ফীতি মানি সাপ্লাই থেকে হয়নি। তাই আমরা এটিকে অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে চাই না। আমরা মনেকরি মূল্যস্ফীতি এসেছে বাণিজ্য ঘাটতি থেকে। তাই আমরা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এবং উৎপাদন বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনব। 

তিনি বলেন, ডিপোজিট কমেছে ঠিক, তবে একেবারেই গ্রথ হয়নি এমনটি নয়। আমাদের ৮ শতাংশ গ্রথ হয়েছে।

এর প্রায় পুরোটাই প্রাইভেট গ্রথ। এটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। অর্থপাচারের বিষয়ে গভর্নর বলেন। ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এটি আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। তবে এই টাকা বিদেশে নিয়ে কেউ বাড়ি করছে, না কি করছে সেটি আমরা জানি না। 

আমরা যখন দেখলাম আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কম মূল্য দেখিয়ে পণ্য আনা হচ্ছে। এরপর বাকি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর এ অর্থ মূলত রেমিট্যান্স থেকে সড়ানো হচ্ছে। তখনই আমরা এটি নিয়ন্ত্রণে জোড়ালো পদক্ষেপ নিয়েছি।

আমানত ও বিনিয়োগে বেধে দেয়া সুদহারের বিষয়ে গভর্নর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে আমানতে সুদহার তুলে দেয়া হয়েছে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভোক্তা ঋণের সুদহার তিন শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। আমরা একটি ভাল সময়ের অপেক্ষা করছি। সময় আসলে বিনিয়োগের সুদহার পুরোপুরি তুলে দেয়া হবে।

এমআরএইচ/টিএইচ