রিজার্ভ ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার

আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৩, ০৯:৪২ পিএম
  • বিপিএম৬ গ্রস হিসাবে রিজার্ভ সাড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলার
  • নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ না করায় তিন মাসের আমদানি দায় নিয়ে অস্পষ্টতা

ঋণের শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল-বিপিএম৬) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন আন্তর্জাতিক এ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা করা হতো। 

বৃহস্পতিবার রিজার্ভের দুটি অঙ্ক প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে দেখা যায়, নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ রয়েছে ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে। 
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিপিএম৬ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব গ্রস হিসাবে প্রকাশ করার রিজার্ভের মধ্যে ব্যবধান হচ্ছে ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আইএমএফ এর স্বীকৃত হিসাবের চেয়ে এ পরিমাণ ডলার রিজার্ভে বেশি দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার গত জুন মাসে জানিয়েছিলেন, নিজস্ব গ্রস হিসাবে রিজার্ভের তথ্যের পাশাপাশি আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হবে। তবে নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হবে না। গতকাল প্রকাশিত বিপিএম৬ রিজার্ভ গ্রস নাকি নিট হিসাব তা ওয়েবসাইটে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে জানিয়েছেন প্রকাশিত রিজার্ভ ‘গ্রস হিসাব’।  

রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে প্রকাশ করলো, যখন আগামী অক্টোবরে ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড় করার পূর্বে অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতি দেখতে আইএমএফ এর একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে অবস্থান করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করছে।

বিপিএম৬ হিসাবে থাকা বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে ৪ মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে। গত নভেম্বরের ঋণ সমঝোতা করার সময় আইএমএফ জানিয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।  আইএমএফ এ ক্ষেত্রে নিট রিজার্ভের কথা বলেছিল বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিট রিজার্ভ প্রকাশ না করায় তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না তা অস্পষ্ট থেকে গেল।  

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়ে গিয়ে ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে বাংলাদেশের রিজার্ভ। ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নের ঘরে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন গত বছরের জুনে নেমে আসে ৪১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।

ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখা ও  আমদানি খরচ মেটাতে গিয়ে গত মে মাসে ৭ বছর পরে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। ২০২২ সালের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কিছুটা কমে আসলেও চাপ রয়েছে এখনো। সর্বশেষ গত ৫ জুলাই মে-জুন সময়ের আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) দায় শোধের পর রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামে।

চাপে পড়া অর্থনীতেতে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়াতে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের সাথে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সমঝোতায় যায় বাংলাদেশ। সংস্থাটির কাছ থেকে প্রথম কিস্তির অর্থ পাওয়ার পূর্বেই আর্থিক খাতের বেশ কিছু সংস্কারের শর্তে সম্মত হয়েছিল বাংলাদেশ। এরমধ্যে রয়েছে মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ গণনা বিপিএম৬ পদ্ধতিতেই করা, বিনিময় হার তুলে দিয়ে বাজারমূখী করা, ডলারের একাধিক দরের ব্যবধান কমিয়ে একক দর করা, সুদহার সীমা ৯ শতাংশ থেকে তুলে দেয়া, রাজস্ব আয় বাড়াতে আর্থিক খাতে সংস্কার করা ইত্যাদি। 

জ্বালানী তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনাসহ প্রায় সবগুলো শর্ত মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। মুদ্রানীতি এক বছরের পরিবর্তে ছয় মাস অন্তর অন্তর ঘোষণা করার কাজটিও গত জুনে সেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০১৪ সালের জুন মাসে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে রফতানি ও রেমিটেন্সে ভর করে ধারাবাহিক উর্ধমূখী প্রবণতা শুরু করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এতে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ২২ বিলিয়ন, ডিসেম্বরে তা ২২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর থেকে রিজার্ভ আর পেছন ফিরে তাকায়নি। ২০১৫ সাল শেষে তা ২৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন, ২০১৬ তে ৩১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন, ২০১৭ তে ৩৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮ তে ৩২ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন, ২০১৯ এ ৩২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন, ২০২০ সাল শেষে তা ৪৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন, ২০২১ সাল শেষে ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিন ও ২০২২ সালে ৩৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভের অর্থে ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন ছাড়াও একাধিক তহবিল পরিচালনা করা হচ্ছে। ইডিএফ তহবিলের আকার ৭ বিলিয়ন থেকে নামিয়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান ও শ্রীলঙ্কাকে কিছু অর্থ ঋণ দিয়েছে। আবার ইডিএফ ছাড়াও আরো দুটি তহবিল গঠন করে পরিচালনা করছে বৈদেশিক মুদ্রায়।

সব মিলিয়ে এর পরিমাণ ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকা দায় বাদ যাবে। এতে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে যায় বাংলাদেশের।

আরএস