চলমান সংকট মোকাবিলায় ‘ডলার বন্ড’ চালুর প্রস্তাব দিয়েছে ইকোনোমিক রিপোর্টারস ফোরাম (ইআরএফ)। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেন কেউ ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে না পারে সে বিষয়টি শক্তভাবে তদারকির পরামর্শও দিয়েছে সংগঠনটি। অন্যদিকে নতুন করে রিজার্ভ থেকে আর কোন ঋণ দেওয়া হবে না (নতুন ফান্ড খোলা হবে না) বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
সোমবার অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে গভর্নরের বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে। সংগঠনটির দশ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নরের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে গভর্নরের ধারাবাহিক পরামর্শমূলক সভার অংশ ছিল এটি।
জানাগেছে, বর্তমানে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ নীতি সুবিধার কারণে ঋণ পুনঃতফসিলের পাহাড় তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোতে। তাই ইআরএফের পক্ষ থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে ইআরএফ সভাপতি রেফায়েতউল্লা মৃধা বলেন, অর্থনীতিকে কিভাবে আরও স্থিতিশীল করা যায় সে বিষয়ে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। গভর্নর আশা প্রকাশ করেছেন, অর্থনীতি খুব দ্রæতই স্থিতিশীল অবস্থার দিকে যাবে। এই মুহূর্তে রিজার্ভ থেকে আর কোনো বিনিয়োগ করবে না বালাদেশ ব্যাংক। নতুন কোন ফান্ড হবে না বলে জানিয়েছেন গর্ভনর।
ইআরএফ সভাপতি আরও বলেন, ‘বিলাসী পণ্য আমদানিতে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা যেন ঠিকমত তদারকি করা হয় সে বিষয়ে তাগিদ দিয়েছি। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কোনোভাবেই যেন অর্থ পাচার না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন আমাদের সহকর্মীরা। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা ‘ডলার বন্ড’ চালু করার কথা বলেছি। এর মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ সহজ হবে।’
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। তা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আবার ব্যাংকগুলো নিজেরাও পুনঃ তফসিল করেছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এরপরও গত বছরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের এই অঙ্ক ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুনঃ তফসিল করা ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতো।
গত ২৩ অক্টোবর গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর সঙ্গে একই বিষয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠক শেষে সানেমের গবেষণা পরিচালক ডক্টর সাইমা হক বিদিশা জানান, স¤প্রতি ব্যাংকের পক্ষ থেকে রেমিটেন্স কেনার ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটা কাজে আসবে না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ডলারের অফিশিয়াল এবং আনঅফিসিয়াল রেটে পার্থক্য থাকবে ততক্ষণ রেমিটাররা অবৈধ পথেই ডলার পাঠাবেন। এছাড়াও একটা শ্রেণি রয়েছে যারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা করে। এই চ্যানেলটা বন্ধ করার জন্য শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততক্ষণ ফরেন কারেন্সিতে একটা আশঙ্কা থেকেই যাবে। এছাড়াও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ সহ আর্থিক খাতের সুশাসন ফেরাতে না পারলে নীতি পরিবর্তনের সুফল যথাযথভাবে আমরা পাবো না।
এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেদিন নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। কেননা এ ধরণের প্রবণতা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজারে লাগাম টানার আগে ‘মূল্য প্রত্যাশা’র লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি মনে করেন, এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ পণ্যের দাম বাড়বে-এমন প্রত্যাশা যখন স্থায়ী হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেঁধে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং মূল্য প্রত্যাশা কমাতে সমন্বিত ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি গ্রহণ এবং তার মাধ্যমে বাজারে সংকেত দিতে হয়। এ ছাড়া দৃশ্যত যেখানে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে ওঠে, সেখানে তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন গভর্নর। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, বিনিময় মূল্য ও ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার বিষয়ে মত দিয়েছেন তারা। এসব লক্ষ্য অর্জনে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন ড. জাহিদ। পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে নীতি প্রণয়ন কৌশল তুলে ধরেছেন তিনি। আগামী মুদ্রানীতিতে এসব পরামর্শের প্রতিফলন থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
আরএস