অস্থির ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে দক্ষ ও সজ্জন ডেপুটি গভর্নর খুঁজছে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত সার্চ কমিটি।
রোববার কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের প্রভাবমুক্ত, সৎ, সাহসী ও নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে বাছাই করা হবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। সর্বজন গ্রহণযোগ্য গভর্নরের ন্যায় ডেপুটি গভর্নর নিয়োগও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করছে সার্চ কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বিদ্যমান অস্থিরতা কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নির্বাহী পরিচালকদের কাছ থেকে বায়োডাটা সংগ্রহ করেছে সার্চ কমিটি।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে দ্বিতীয় দিনেরমতো কমিটির বৈঠক হয়েছে। এর আগে প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার। আগের বারের মত এবারও সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিক ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাপা উত্তেজনা চলছে। সদ্য পদত্যাগী দুই ডেপুটি গভর্নরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশের প্রভাবশালী কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর হয়ে কাজ করেন। তারা অধস্তনতদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দুর্নীতির ফাইল গায়েব করে দেন। এমনকি আইন লঙ্ঘন করে বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে কয়েকটি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিতদের নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও ব্যাংক লুটেরাদের চিহ্নিত দোসরেরা ডেপুটি গভর্নর হলে ফের আন্দোলন হবে। আমরা আর কোন অসৎ দুর্নীতিবাজকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে বসতে দেব না।
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি করে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও সদ্য পদত্যাগী খুরশীদ আলমকে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কাজী সাইদুর রহমান বিভিন্ন গ্রুপকে অনৈতিক সুবিধা দিতেন। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্যতম দোসর সদ্য সাবেক পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে হুমকি দিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখেন। এবার আমরা চুপ করে বসে থাকব না।’
বর্তমানে দুর্নীতিগ্রস্ত কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু নতুন গভর্নর এসেছেন। তিনি অনেক দক্ষ ও সজ্জন ব্যক্তি তাই আমরা আশাকরি তিনি দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করবেন। তাই সকলের নাম বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা উচিত হবে না। কিন্তু কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন যাদের অপকর্মের কথা সবাই জানেন। এর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক লুটেরা এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সবার জানা। গভর্নরের নামে ৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে তাকে ঢাকা থেকে বগুড়ায় বদলি করা হয়েছিল। তবে এস আলমের প্রভাব খাটিয়ে তিনি ফের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। এছাড়া আইটি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক দেব দুলাল রায়ের বিরুদ্ধে সিআইবি থেকে এস আলমের দুর্নীতির তথ্য সড়ানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যা তদন্ত করা প্রয়োজন।
অপর এক নেতা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির আলামত নষ্টের অভিযোগ রয়েছে নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে। গোয়োন্দাদের সূত্রে একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জয়ের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি তিনি জোর গলায় সবার কাছে বলতেন এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতেন।’
এছাড়া বিনা লাইসেন্সে দীর্ঘদিন এমএফএস প্রতিষ্ঠান ‘নগদকে’ ব্যবসার অনুমতি দিয়েছেন মেজবাউল হক। এছাড়া বিভিন্ন পেমেন্ট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্য ল্যাপটপ ক্রয়ের প্রকল্পের পরিচালক থাকাকালীন ওই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বাজারমূল্যের কয়েকগুণ বেশি দামে ল্যাপটপ ক্রয়ের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে তার স্ত্রী সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের দাপট দেখিয়ে সব ধামাচাপা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের পদে বসে আছেন। এখন তিনি ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য তদবির করছেন বলে জানা গেছে।’ তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানতে তাদের দপ্তরে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের লক্ষ্যে চার সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কামাল মুজেরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নজরুল হুদা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব বদরে মুনির ফেরদৌস। এই কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বদরে মুনির ফেরদৌস।
ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের বিষয়ে সার্চ কমিটির সদস্য মুস্তাফা কামাল মুজেরী বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেপুটি গভর্নরদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এ পদে যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর ও বাহির যেখানে যোগ্যদের পাওয়া যাবে সেখান থেকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। আর যেহেতু ডেপুটি গভর্নর পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে, তাই এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সেদিন তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠান। এরপর গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আহসান এইচ মনসুর।
এর আগে গত ১২ আগস্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ কাজী ছাইদুর রহমান ও ডেপুটি গভর্নর-৩ খুরশিদ আলম পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নরের চারটি পদেই নিয়োগ দেয় সরকার। সবশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালক মো. খুরশীদ আলম এবং প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পান।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিনই (৬ আগস্ট) অস্থিরতা শুরু হয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং চার ডেপুটি গভর্নরের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেন কর্মকর্তারা। এরপর গভর্নর ও দুই ডেপুটি গভর্নর পদত্যাগ করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও শীর্ষ দুই কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। এরা হলেন নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ নাসের ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
সোহেল/ইএইচ