লাগামহীন সবজির বাজার, দিশাহারা ক্রেতা

আমার সংবাদ ডেস্ক: প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৪, ১২:৩১ পিএম

সাধারণ মানুষের আয় না বাড়লেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে । আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ প্রায় সব ধরনের সবজি আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ডিমও চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

এ যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের দেশ! মহাসড়কে নেই চাঁদাবাজি কিংবা পুলিশি উৎপাত। তারপরও কৃষকের ২০-২৫ টাকার ফসল ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে দাম ওঠে যায় একশ টাকার ওপরে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা যেমন থাকেন লোকসানে, তেমনি সবজি কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা

সবজির সেঞ্চুরি:
গতকাল শুক্রবার (১১অক্টোবর) ঢাকার কারওয়ান বাজার, মহাখালী,বনানীও শ্যামবাজারে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১০০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে চারটি সবজি। এর মধ্যে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৮০-৯০, পটোল ৬০-৮০, পেঁপে ৫০-৬০ ও মুলা ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে।

যেমন– বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৪০ টাকা দরে। গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৬০ টাকা দরে। মাসখানেক আগে বরবটি ও গোল বেগুনের কেজি কেনা গেছে যথাক্রমে– ৬০ ও ৭০ টাকার আশপাশের দরে। এক মাস আগে কাঁকরোল কেজি ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। সবজি দুটি কিনতে ক্রেতাকে এখন গুনতে হচ্ছে অন্তত ১০০-১২০ টাকা। ঝিঙা ও ধুন্দলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা দরে। দুই সপ্তাহ আগেও সবজি দুটি কেনা গেছে ৭০ টাকার আশপাশের দরে। তবে কাঁচামরিচের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। কারওয়ান বাজারের মতো পাইকারি বাজারে কাঁচামরিচের কেজি ৩০০-৩২০ টাকায় বিক্রি হলেও শ্যামবাজার কাঁচাবাজারে বিক্রি হয়েছে ২৮০-৩০০ টাকা দরে। তিন দিন আগে কাঁচামরিচের কেজি ছিল ২০০-২৪০ টাকা।

সাধারণ জনগণের ভাবনা:
কাজী পলাশ নামে এক ক্রেতা বলেন, বাজারে প্রায় সব সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে। সবজির এত দাম হলে স্বস্তি মেলে কী করে? সবজিতে বাজার ভরপুর। অথচ দামের বেলায় মনে হয় এগুলো বিরল প্রজাতির সবজি। দু-তিন রকম সবজি কিনলেই দু’শো টাকার ওপরে চলে যাচ্ছে। মাছ-মাংস বাদ দিয়ে সবজি কিনে খাবো তারও উপায় নেই। মোটকথা আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে।

তিনি বলেন, আমরা তো ভেবেছিলাম নতুন সরকার ঠিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হচ্ছে না। বাজার এখনও সিন্ডিকেটের দখলেই রয়ে গেছে।

মুজাহিদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বর্তমান বাজারে আমাদের মতো ব্যাচেলর শিক্ষার্থীরা খুবই কষ্টে আছে। কোনো কিছুরই দাম স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কোনোভাবেই মিলরেট ১২০ টাকার নিচে আসে না, যেখানে আগে অনেক ভালো খেয়েও ৮০ টাকার বেশি হতো না। দুইটা টিউশনি করাই, সবকিছুর দাম বাড়লেও তো আমাদের আয়ের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

কী বলছেন আড়তদাররা:

বাংলাদেশ পাইকারি কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, এ বছর ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ অস্বাভাবিক। তাতে সবজি ক্ষেত ডুবে গেছে। । তিনি বলেন, বছরের এ সময় শীতের কিছু সবজি আগাম বাজারে আসে। যেমন– ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিম। এসব সবজি উত্তরবঙ্গ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে বেশি হয়। কিন্তু সেসব এলাকায় পানির কারণে বীজ লাগানো যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সবজির সরবরাহ কমছে। তাছাড়া এ সময় শ্রমিকদের মজুরিও বেশি দিতে হয়। সেজন্য উৎপাদন এলাকায় কৃষকরাও এখন তুলনামূলক দাম বেশি নিচ্ছেন।  

সরকারের উদ্যোগ এবং ব্যর্থতা:

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকেরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে হচ্ছে না, যা বাজারের বর্তমান অস্থিরতার অন্যতম কারণ। টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) মাঝে মাঝে নিত্যপণ্য বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করে, কিন্তু এটি শুধু বড় শহরের সীমিতসংখ্যক জনগণের জন্য কার্যকর। এই উদ্যোগগুলো গ্রামাঞ্চলে বা তুলনামূলকভাবে কম জনবহুল এলাকায় পৌঁছাতে পারে না। এছাড়া, অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের নিয়মকানুনকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
সরকারকে বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা, টিসিবি‍‍`র কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়া, কৃষকদের জন্য সঠিক দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া দরকার, যাতে তারা ন্যায্যমূল্য পায় এবং পণ্যের সরবরাহও ঠিক থাকে।

কাঁচা বাজার নিয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা:

বাজার বিশ্লেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও কমার প্রধান বিষয় হলো বাজারে পণ্যের সরবরাহ। সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যার প্রভাব পড়েছে চাল, সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বরাবরের মতোই সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। ঘাটতি পূরণে আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা গেলে আগামী দুই মাসের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। 

তিনি আরো বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে তাহলে বাজারে কিছুটা স্থিতিরতা আসতে পারে কারণ এর ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের কাজ করতে ভয় পাবে।

অর্থ উপদেষ্টা টাস্ক ফোর্স গঠনের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বললে সেটার কোন রকম উন্নতি চোখে পড়ে নাই। এই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের আশা ও চাওয়া, কাচা বাজারের দাম যেন হাতের নাগালে থাকে সেই দিকে যেন সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান।

এফআর/বিআরইউ