গ্রন্থাগার মানেই হাজারো বইয়ের সমারোহে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যস্ততা। কিন্তু, চিরচেনা পরিবেশের বিপরীতমুখী চিত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। শিক্ষার্থী বিমুখ চবি গ্রন্থাগার। এই বিমুখতা একদিনের নয়, দীর্ঘদিনের চিত্র।
অবশ্য, গ্রন্থাগার নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। লক্ষাধিক বইয়ের সমাহার হলেও পাওয়া যায় না অনেক প্রয়োজনীয় বই। ফলে পড়তে আসতে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরাও বই নিয়ে গ্রন্থাগারে ঢুকতে পারেন না। তেতলা বিশিষ্ট হলেও প্রায় সময়ই শূন্য পড়ে থাকে চেয়ারগুলো৷ নানান অভিযোগে ফাটছেন শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজনীয় অনেক সুযোগ সুবিধার ঘাটতি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা৷
প্রতিদিন লাইব্রেরিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি উন্মুক্ত পাঠকক্ষ। যেখানে নিয়মিতই ভিড় করে শিক্ষার্থীরা। এর পাশেই আছে পত্রিকার টেবিল এবং লাইব্রেরিতে প্রবেশের গেইট। হট্টগোল হলেও এখানে বসে শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করছেন পাঠে মনোযোগ দেওয়ার।
গ্রন্থাগার নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগ। এর নেপথ্যে আছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব। বই সংগ্রহের জটিল ব্যবস্থাপনা, পানির পর্যাপ্ত ফিল্টার না থাকা, প্রয়োজনীয় বই না থাকা এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বই নিয়ে প্রবেশে বাঁধা ইত্যাদি।
এনিয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিমুল হাসান তানিম বলেন, লাইব্রেরিতে বই নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। বই না আনতে দেওয়ার এই আত্মঘাতী নিয়মের বেড়াজালে পড়ে লাইব্রেরির প্রতি শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। লাইব্রেরিতে নেই পাঠ্যসূচির অনেক প্রয়োজনীয় বই৷
তুলনা দেখিয়ে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সংস্কৃত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অভিষেক সোম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মতো প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। দেখুন! ওরাও শিক্ষার্থী, আমরাও শিক্ষার্থী। ঢাবি প্রশাসন শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তরিক হলে চবির প্রশাসন ব্যর্থ কেন?
শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার বলেন, এখানে বই নিতে গেলেও নানা প্রসেসিং এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আইডি কার্ড দেখানো, না হলে ব্যাংক স্লিপ দেখানো আরও কত কি! আমি একদিন ব্যাংক স্লিপ দেখিয়ে বই নেওয়াতে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। যা খুবই বিরক্তিকর ছিল।
তানিয়া আক্তার খানিকটা হতাশা নিয়ে বলেন, চবিতে ভর্তি হয়েছি অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু লাইব্রেরিতে এসে পড়ালেখার বেস্ট (best) সুবিধার বিপরীতে আমরা গুড সুবিধাও পাচ্ছি না। আমাদেরকে প্রভাবিত করার মতো লাইব্রেরিতে তেমন কিছুই নেই।
বই নিয়ে ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদভুক্ত ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী খায়রুল ইসলাম বলেন, মূলত বিষয়টা এমন যে, আমরা নিজেদের বই নিয়েও পড়তে পারি না।এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় এবং ভালো লাগার মতো বইও নেই পড়ার জন্য। এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার। এই গ্রন্থাগারের কাজ কি তাহলে?
বাহিরে কয়েকটি টেবিলে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। পাশেই আছে লাইব্রেরী অডিটোরিয়াম। যেখানে নেই পড়ার পরিবেশ। এনিয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত রাজনীতি বিজ্ঞানের ২য় বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান বলেন, এখানে সবসময় ভিড় করে সবাই। কারণ, তারা নিজের বই নিয়ে প্রবেশ করতে পারছে না। আর অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হলে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এই বিষয়ে চবি প্রশাসনের তৎপরতা নিয়ে তিনি আরও বলেন, বাহিরের শব্দ প্রতিরোধে লাইব্রেরির নিচ তলায় মূল ফটকে কাচের দরজা লাগানোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত এক সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনও কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে এটি জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেননি। লাইব্রেরির মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে প্রবেশ নিষেধ। এই বঙ্গবন্ধু কর্নারেও আগে বসা যেত না। বারবার অভিযোগের ফলস্বরূপ এখানে আমরা এখন বই নিয়ে পড়তে পারছি। বলতে গেলে, আমরা এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আঁটকে আছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী তাহসিন আলম লাইব্রেরি নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করে বলেন, এখানে আমরা নিজেদের পছন্দ মতো বই নিয়ে পড়তে পারি না। বই দেখে-শুনে, যাচাই-বাছাই করে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। একান্ত প্রয়োজন হলেও লাগবে বই কোড। ফলস্বরূপ, প্রচুর ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার সমৃদ্ধ সাইবার কক্ষ থাকলেও এখানে সমস্যার কমতি নেই।
এনিয়ে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ফার্মেসী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, লাইব্রেরির ওয়েবসাইট আরো আপডেট করা উচিত। এখানকার অধিকাংশ কম্পিউটার ঠিক মতো কাজ করে না, যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায়। একটি কম্পিউটার মোটামুটি কাজ করলেও সেখানে সকল বইয়ের তালিকা নেই। তাই দীর্ঘ সময় নিয়ে বই খুঁজতে হয় এনালগ পদ্ধতিতে। অনেক সময় বইয়ের ক্ষেত্রে শুধু কোড মিলে। বইয়ের নাম ও লেখকের নাম মিলে না।
বিরক্তি প্রকাশ করে ঐ শিক্ষার্থী আরও বলেন, তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াল! আপনি নিজের বই পড়তে পারবেন না। পড়তে হলে লাইব্রেরির বই নিয়ে পড়তে হবে। তাও অঢেল সময় নিয়ে আগে বই খুঁজে বের কর,তারপর হবে পড়া!
বইয়ের এত ঝামেলা নিয়ে শিক্ষা অনুষদের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি শহর থেকে আসি। বই নিয়ে ঝামেলার দরুন হাতে সময় থাকলেও লাইব্রেরিতে আসি না। আমি আধা ঘণ্টা ধরে বই খুঁজব! নাকি ট্রেন ধরব! পড়ার কথা তো বাদই দিলাম!
বাংলা বিভাগের ছাত্রী সানজিদা আক্তার বলেন, এখানে বিদ্যুৎ এর সমস্যা আছে। লোডশেডিং এ সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে শুধু বাতি জ্বলে, পাখা চলে না। গরমে পড়াশোনায় মন বসে না। আইপিএস এর ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি। এখানে ওয়াইফাই চালু করা প্রয়োজন। কারণ,লাইব্রেরির ভিতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না।
লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়ার বিষয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা। আর প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইংরেজি। জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ইংরেজি চর্চার আবশ্যকতা বিবেচনায় লাইব্রেরিতে ইংরেজি পত্রিকার সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
নিচ তলায় পানির ফিল্টার দীর্ঘদিন যাবত নষ্ট উল্লেখ করে বিজ্ঞান অনুষদের আরেক শিক্ষার্থী শাফায়েত মোমেন বলেন, নিচ তলায় ওয়াশরুমের অবস্থাও করুণ। সেখানে ভাঙা আয়না, নেই কোনো টয়লেট পরিষ্কারক, নেই সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অপ্রতুল ডাস্টবিন আর দেওয়ালে অমূলক কথার ছড়াছড়ি। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এবং দুর্গন্ধের কারণে অনেকেই এড়িয়ে চলেন ওয়াশরুম।
এসএম