চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে চবি শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ শিক্ষকবৃন্দের একাংশ। উক্ত কর্মসূচির প্রতিবাদে পাল্টা মানববন্ধন করেছে সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ।
সোমবার (১৬ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরে মানববন্ধন করেন সমিতির সভাপতি ও শহীদ মিনারের সামনে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেন সাধারণ সম্পাদক।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক শিক্ষকদের জৈষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন, সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে গড়িমসি ও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এবং চারুকলা ইন্সটিটিউটের অচলাবস্থা নিরসনের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মানববন্ধন করে সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল হক।
সভাপতির কর্মসূচির প্রতিবাদে `অবৈধ মানববন্ধন মানি না` ব্যানারে পাল্টা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. সজীব কুমার ঘোষ ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ।
মানববন্ধনে সভাপতি আব্দুল হকের নেতৃত্বে বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগের শিক্ষকগণ অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে আব্দুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ হলো সিন্ডিকেট। কিন্তু, সেখানে কোন শিক্ষক প্রতিনিধি নেই। প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটে বিভিন্ন ক্যাটাগরির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন দিচ্ছে না। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার। আমাদের দাবি অবিলম্বে সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন দিতে হবে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হতে হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যে আইন মোতাবেক চলে সেই আইনের শাসন মেনে চলে না প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রায় আড়াই মাস যাবত অচল। যা এখনও অচলাবস্থায় আছে।
তিনি আরও বলেন, সার্বিক বিষয়গুলো বারবার জানানোর পরেও প্রশাসন এ নিয়ে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে মানবন্ধন করছি। উল্লেখিত বিষয়ে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে যদি সন্তোষজনক সমাধান না আসে তাহলে আমরা পরবর্তীতে আরও বড় কর্মসূচি ঘোষণা করব।
এসময় ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, আজ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ১৯৭৩ এর সঠিক বাস্তবায়নর দাঁড়িয়েছি। প্রশাসনের উর্ধতন কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। চারুকলার শিক্ষার্থীরা আজ জিম্মি হয়ে আছে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক।
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হানিফ সিদ্দিকী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু, প্রশাসন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। শিক্ষকদের পদন্নোতি কোনো করুণার বিষয় নয়। এটা তাদের যোগ্যতার ফলাফল। কিন্তু, প্রশাসন শিক্ষকদের পদন্নোতি থেকে বঞ্চিত করছেন। তাই আজ আমরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। আমাদের ন্যায্য দাবীগুলো মেনে নিতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে চারুকলার অচলাবস্থা নিরসন করতে হবে।
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হচ্ছে। সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধি নেই। নির্বাচনও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সিন্ডিকেট সভায় যা খুশি তা পাস করিয়ে নেয় প্রশাসন। এতে গণতান্ত্রিক আইনের শাসন ব্যহত হচ্ছে। এই মানববন্ধনের উদ্দেশ্য হলো আইনের শাসন নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করা।
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন তৈরি করেছেন। কিন্তু এখানে বিশ্ববিদ্যালয় এক্ট-৭৩ এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। আমরা ক্যাম্পাসে অস্থিরতা তৈরির জন্য এখানে দাঁড়াইনি। আমরা আজ আইনের পক্ষে, শিক্ষকদের পক্ষে ও চারুকলার পক্ষে দাঁড়িয়েছি।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মুহাম্মদ তৌহিদ হোসেন, ইঞ্জিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রাশেদ মোস্তফা, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ প্রমুখ।
অন্যদিকে সভাপতির মানববন্ধনের প্রতিবাদ জানিয়ে একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বর এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও অন্যান্য সাধারণ শিক্ষকদের নিয়ে পাল্টা মানববন্ধন করেছে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সজীব কুমার ঘোষ।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি। তার একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ২০২২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাধারণ শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে আসছি। কিছু কিছু অমীমাংসিত দাবি যেটা প্রশাসনের কাছে আমরা অনেক দিন চেয়ে আসছিলাম তার মধ্যে ছিল সিন্ডিকেটে শিক্ষক ক্যাটাগরির নির্বাচন, শিক্ষকদের প্রমশন বোর্ড এবং শিক্ষকদের আরও কিছু দাবি। এসকল বিষয়ে আমরা সাধারণ সভা আহ্বান করি। যেখানে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে প্রশাসন আশ্বাস দেয় যে, জানুয়ারির মধ্যেই সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সাধারণ সভায় সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো হয় এবং প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রতি আশ্বাস পোষণ করা হয়।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, আমাদের আরেকটি দাবি ছিল শিক্ষকদের প্রমোশন বোর্ড। গত দুটি সিন্ডকেটের আগে ১৮৪ জন শিক্ষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৮০ জনের প্রমোশন বোর্ড নিশ্চিত হয়েছে। বাকি ৪টি বোর্ডের তারিখ ঘোষণা করা হলেও মাননীয় উপাচার্য অফিসিয়াল কাজের জন্য বোর্ড সম্পন্ন করতে পারেনি। এজন্য উপাচার্য আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং জানুয়ারির মধ্যে সেই বোর্ডগুলো নিষ্পত্তি করার কথা বলছেন। আমাদের দাবিগুলো প্রশাসন ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছেন এবং বাকিগুলো নিষ্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রশাসনের এসব প্রতিশ্রুতি, সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সদস্যদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে এমন মানববন্ধনকে আমার কাছে মনে হয়েছে অন্যায়, অপ্রয়োজনীয়। তার চেয়ে প্রশাসনের ছোটখাট বিষয়গুলো মিমাংসা করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বারবার অনুরোধ করা হলেও তথাকথিত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সমিতির সাধারণ সভায় বিভিন্ন বিষয় তিনি উত্থাপন করে পাস করিয়ে নেন। তাছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউটের সমস্যা সমাধানে প্রশাসন কাজ করলেও হীন ব্যক্তি স্বার্থে, প্রশাসনের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবৈধভাবে মানববন্ধন করছে তারা। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের এই অবৈধ মানববন্ধনের বিরুদ্ধে আমাদের আজ এই অবস্থান।
এ মানববন্ধনে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাহবুবুল আলম, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক উপস্থিত ছিলেন।
কেএস