সিটি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদে নিজেরাই দিলেন নিজেদের নিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ০২:১০ পিএম

নিজেদের মতো করে কলেজের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ দখল করে নিলেন তারা। নিজেরাই দিলেন নিজের নিয়োগ। তাও আবার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের মতো পদে। এদের একজন নেয়ামুল হক অপরজন মোখলেছুর রহমান। রাজধানীর সিটি কলেজের এই দুই অধ্যাপকের একজন ইংরেজি বিভাগের অপরজন মার্কেটিংয়ের শিক্ষক। দু‍‍’জনই এখন এই কলেজেরই স্বঘোষিত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো রাজধানী ঢাকার এই নামকরা কলেজটিও পড়ে অনিশ্চয়তায়। তবে দুইদিন যেতেই সিটি কলেজে পড়ে নতুন সমস্যায়। কলেজের অধ্যক্ষকে চাপের মুখে পদত্যাগ করায় শিক্ষার্থীরা। যুক্ত ছিলেন একদল শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থী। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় অধ্যক্ষ প্রফেসর বেদার উদ্দিন আহমেদকে। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা জিম্মি থাকার পর প্রাণভয়ে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

সে ঘটনা সবার জানা। কিন্তু এরই মধ্যে সুযোগসন্ধানী অধ্যাপক নেয়ামুল হক ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো নিজে গিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে তার চেয়ারে বসে পড়েন। আর নিজেকে ঘোষণা করেন অধ্যক্ষ হিসেবে। যা ছিলো সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। একই পথে হেঁটেছেন মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর মো. মোখলেছুর রহমানও। তিনিও নিজেকে কলেজের উপাধ্যক্ষ ঘোষণা করে তার চেয়ারে বসে পড়েন। সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে হটিয়ে এই পদ দখল করেন তিনি।

দাবি করা হচ্ছে শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নেয়ামুল হককে অধ্যক্ষ ও মার্কেটিং বিভাগের মোখলেছুর রহমানকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে চেয়ারে বসিয়ে চলে যায়।

তবে, গত ৭ আগস্ট চেয়ারে বসলেও ২৭ আগস্ট অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ দেখিয়ে নেয়ামুল হককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে পদত্যাগ দেখিয়ে মোখলেছুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ দেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বঘোষিত অধ্যক্ষ হওয়া এবং পরে বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া দুটোই নিয়মবহির্ভূত।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিধিতে অধ্যক্ষ নিয়োগের ধারা ৪ (ক)-এর উপধারা ৩ (i)- এ বলা হয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষের অবর্তমানে উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠতম পাঁচজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে ৬ মাসের মধ্যে বিধি অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অধ্যক্ষ নিয়োগ করতে হবে। ধারা-৫ এ বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজের গভর্নিং বডির সভায় প্রার্থীর নাম উপস্থাপন হবে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে অধ্যক্ষ পদে আগ্রহী প্রার্থী নয় এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত সেই অধ্যক্ষ নতুন অধ্যক্ষকে নিয়োগের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন।

এছাড়াও বিভাগীয় কমিশনার অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারলেও উপাধ্যক্ষ নিয়োগের কোনো বিধান নেই। কিন্তু নেয়ামুল হক ও মোখলেছুর রহমান বিধিবহির্ভূত করে নিজেরাই চেয়ারে বসে গেছেন এবং পরে নিয়োগও পেয়ে গেছেন। অথচ সিটি কলেজের দায়িত্বরত অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেই সেই চেয়ারে বসা নেয়ামুল হকের চেয়েও যোগ্য শিক্ষক কলজেটিতে রয়েছে।

এদিকে হুমকির মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন অধ্যক্ষ প্রফেসর বেদার উদ্দিন আহমেদ। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা, মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।

গত ১০ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি থানার জিডি ও বিভিন্ন দফতরে দেওয়া আবেদনে বেদার উদ্দিন অভিযোগ করেছেন, গত ৭ আগস্ট কয়েকজন উশৃঙ্খল তরুণ-তরুণী তার কক্ষে ঢুকে পড়ে। তারা রুমে আগে থেকে অবস্থান করা শিক্ষকদের বের করে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর তাদের সঙ্গে থাকা একটি লিখিত কাগজে স্বাক্ষর করার জন্য তাকে চাপ দিতে থাকে। কাগজে কী লেখা আছে তা না দেখে তিনি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে তারা তাকে অপমান করার হুমকি দেয়।

বেদার উদ্দিন লিখেছেন, তা সত্ত্বেও আমি দু-একদিন সময় চেয়ে কোনোভাবে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এভাবে প্রায় ৫ ঘণ্টা বাদানুবাদের এক পর্যায়ে তারা আমাকে স্বাক্ষর না করলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার হুমকি দেয়। পরে অস্ত্রের মুখে, নিজের জীবন বাঁচাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হই।

এ বিষয়ে অধ্যাপক বেদার উদ্দিন বলেন, এই শিক্ষকরা অবৈধভাবে চেয়ার দখল করেছেন। এখন তারা আমার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তোলার চেষ্টা করছেন। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে আমার কাজে স্বচ্ছতা থাকার পরেও কিছু স্বার্থপর সহকর্মীর কারণে আমাকে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। আমি প্রতিকার চেয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। আমি ন্যায় বিচার চাই।

নিজেকে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক দাবি করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিলো। কিন্তু গত ১৬ জুলাই একাদশ শ্রেণির (সেশন:২০২৪-২০২৫) ভর্তি কার্যক্রম চালু থাকায় ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়। আর সে কারণেই সেদিন সকাল থেকে মেইন গেট বন্ধ ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু কয়েকজন শিক্ষক এই ঘটনাকে পুঁজি করে আমার পদত্যাগের দাবি সামনে এনে শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তোলে। যদিও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়।

বেদার উদ্দিন বলেন, কলেজ গ্রাউন্ডে ৬টি ব্যাংক কাউন্টার রয়েছে সেগুলোর নিরাপত্তার জন্যও কলেজের গেট বন্ধ রাখতে হয়। যার ব্যাখ্যা ও প্রমাণ কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আমি দিয়েছি।

তার অভিযোগ, পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে কয়েকজন শিক্ষক এই অন্যায় কাজগুলো করছেন। তিনি বলেন, বহিরাগতদের ব্যবহার করে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেই ৮ জন শিক্ষককে কলেজ ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন কাজী নেয়ামুল হক।

গত ১৩ আগস্ট জারি করা এক অফিস আদেশে এই অবাঞ্ছিত শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে অধ্যক্ষ প্রফেসর বেদার উদ্দিন আহমেদ, উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ছাড়াও রয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক মো. দেলোয়ার রহমান দিপু, ফরিদা পারভীন, চৈতালী হালদার, মো. আহসান হাবীব রাজা, মোহাম্মদ কায়কোবাদ সরকার ও আল ফয়সাল আক্তার।

জানা গেছে, নতুন দায়িত্ব নেওয়া অধ্যক্ষের নির্দেশে এই শিক্ষকদের নাম বিভাগ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কলেজের শিক্ষকদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। কলেজের বিভাগীয় সামাজিক গ্রুপগুলো থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে তাদের নাম।

কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে বেশ কয়েকটি ধাপ মেনে চাকরিচ্যুত করতে হয়। যার কোনো কিছুই মানছেন না বর্তমান অধ্যক্ষ নেয়ামুল হক।

কলেজে অবাঞ্ছিত হওয়া শিক্ষকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, কলেজ থেকে আমরা সরাসরি কোনো নোটিশ পাইনি, শোকজও পাইনি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি আমাদের ৬ জন শিক্ষক ও সাবেক অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে আমাদের নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে, বলেন ওই শিক্ষক।

অসামাজিক কাজে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সামাজিকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষক। সমাজে আমার সম্মান আছে। আমার পরিবার আছে। অথচ রাজনৈতিক কারণে আমাদের ওপর অসামাজিক ও কলেজের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো আমাদের জন্য লজ্জার।

বর্তমান অধ্যক্ষ এই শিক্ষকদের সবার বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে পরিবার নিয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি তারা জানিয়েছেন। তবে এখনো কোনো প্রতিকার মেলেনি।

 নিয়ম বহির্ভূতভাবে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কে আপনাকে নিয়োগ দিলো? এমন প্রশ্ন করা হলে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়া কাজী নেয়ামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে কলেজের শিক্ষক ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা নিয়োগ দিয়েছে।

আপনার নিয়োগপত্রে কে স্বাক্ষর করেছে? গনমাধ্যমের এমন প্রশ্ন শুনে জবাব না দিয়েই কল কেটে দেন নেয়ামুল হক।

যোগাযোগ করা হয় উপাধ্যক্ষের চেয়ারে বসা মোখলেছুর রহমানের সঙ্গেও। তিনি নিজের নিয়োগ বৈধ দাবি করে বলেন, আমাকে কলেজের শিক্ষক ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা নিয়োগ দিয়েছে। আমার নিয়োগপত্র আছে।

আগে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী পদত্যাগ না করে পালিয়ে গেছেন। তাকে কলেজের পদত্যাগের জন্য আনা হয়েছিলো। কিন্তু পদত্যাগ না করে তিনি পিয়নের মোটরসাইকেলে করে পালিছেন। এরপর আমাকে শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব দিয়েছে, বলেন মোখলেছুর।

শিক্ষাক্ষেত্রে এমন পদত্যাগ নীতি ও নৈতিকতা বিরুদ্ধ, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জোর করে পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা মল্লিক বলেন, শুধু সিটি কলেজ না দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের মব-জাস্টিস হয়েছে। অথচ এমনটা না করার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ নির্দেশনা দিয়েছেন।

কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বিধি অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে রাজনৈতিক কারণে কিংবা অন্য কারণে মব-জাস্টিস নিষেধ করা হয়েছে। এমন কি প্রধান উপদেষ্টাও তার ভাষণে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন, বলে স্মরণ করিয়ে দেন এই সংবাদকর্মী।

তিনি আরও বলেন, সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও অনেক সুযোগসন্ধানী এই কাজটি করেছে। যা কোনোভাবেই নীতি ও বিধি মোতাবেক হয়নি।

বিআরইউ