জাবি সংস্কারে ৩৬ দফা দাবিতে আল্টিমেটাম

জাবি প্রতিনিধি: প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম

গণবান্ধব বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নতুন প্রশাসনকে সহায়তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) প্রশাসনের কাছে ৩৬ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দিয়েছে ‘জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলন’। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ৩০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।

গতকাল মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ে ৩৬ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেয়া হয়। স্মারকলিপিতে উল্লিখিত দাবিগুলো হলো—

১.  অবিলম্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা জাকসু, হল সংসদ এবং বিভাগীয় সংসদ কার্যকর করতে হবে।

২. ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি ‍‍`রিসার্চ টিম‍‍` গঠন করে যৌক্তিক সমাধানে আসতে হবে। এই কমিটি ছাত্ররাজনীতি থাকা বা না থাকার রূপরেখা প্রকাশ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত আসতে হবে৷

৩. কলা ও মানবিকী অনুষদে মাদ্রাসা এবং মানবিক বিভাগ হতে আসা ছাত্রদের ভর্তিতে সমস্ত বৈষম্য দূর করতে হবে। শিফটভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে অভিন্ন প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত এবং অভিন্ন মেধাতালিকা প্রণয়ন করতে হবে । সকল পোষ্য কোটা বাতিল কিংবা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

৪. জনকল্যাণমুখী গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও গবেষণা-বরাদ্দের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে এবং প্রাণ-প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি এমন সমস্ত প্রজেক্ট বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাসের লেক ও পুকুর সংস্কার এবং অতিথি পাখির অভয়ারণ্য ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে।

৬. প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই ক্লাস শুরু এবং যথাসময়ে শেষ করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক ক্যালেন্ডার দিতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে মনিটর হবে। একজন শিক্ষক ফুলকোর্স ও হাফকোর্সে কতটি ক্লাস নিবেন তা পূর্ব নির্ধারিত হতে হবে। পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখসমূহ ক্যালেন্ডারে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল ব্যবহার সাপেক্ষে ক্যাম্পাসে ফ্রি ইন্টারনেট চালু করতে হবে।

৭. শিক্ষক নিয়োগে গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং পিএইচডিধারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে অবশ্যই লিখিত, ছাত্রছাত্রীদের সামনে ডেমো ক্লাস ও ভাইভা - এই তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। এসএসসি, এইচএসসি এর ফলের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিতে হবে।কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের ব্যবহার, গবেষণা, নিরপেক্ষতা ও পাঠদানের দক্ষতা ইত্যাদি মূল্যায়নের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

৮. গ্রহণযোগ্য ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের হল প্রশাসনে নিয়োগদানের মাধ্যমে  হলসমূহের সমস্ত কাজ সম্পাদন করতে হবে। হলে গণরুম সংস্কৃতি এবং কোনো রাজনৈতিক ব্লক তৈরি হতে দেয়া যাবে  না। র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে হবে।

৯. বিগত স্বৈরাচারী আমলে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের স্বচ্ছতা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

১০. সকল ধরনের প্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত এ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

১১. প্রত্যেক বিভাগে মান-উন্নয়ন পরীক্ষা চালু এবং ফাইনাল পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। টিউটোরিয়ালের খাতা ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে৷

১২. পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর চিকিৎসা কেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত ওষুধ ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হবে।

১৩. বিভাগ উন্নয়ন ফিসহ সকল প্রকার অবৈধ ফি বাতিল করতে হবে এবং রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট এর নিবন্ধন ফি একেবারে তুলে দিতে হবে বা কমাতে হবে।

১৪. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং এই কমিশন পরবর্তীতে দুর্নীতি রুখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে একটা ‍‍`ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি‍‍` গঠন করতে হবে।

১৫. লাইব্রেরিকে আধুনিকীকরণ, ই-লাইব্রেরির ব্যবস্থা, প্রতিটি হলে পাঠকক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে হবে।

১৬. সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিমণ্ডলের জন্য বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বছরের বাজেট প্রশাসন ও প্রতিটি বিভাগ কীভাবে খরচ করেছে তা প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে হবে৷

১৭.অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্লাসরুম সংকট নিরসন করতে হবে। পর্যাপ্ত এক্সাম হল, সেমিনার ও লেকচার থিয়েটার বানাতে হবে৷

১৮. ডাইনিংয়ে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে এবং ডাইনিং কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

১৯. উইকেন্ড এবং ইভিনিং কোর্সের নামে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে।

২০. বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ চালু করতে হবে।

২১. মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের পর্দা পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত, প্রতিটি মসজিদে স্থায়ী ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগ এবং তাদের সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।  কেন্দ্রীয় মসজিদের সার্বিক সংস্কার এবং নারীদের জন্য নামাজের সুব্যবস্থা করতে হবে।

২২.সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয় মন্দিরের জায়গা স্থায়ীকরণ করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ মন্দির নির্মাণ, স্থায়ীভাবে পুরোহিত নিয়োগ, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ মন্দিরের জন্য  বাৎসরিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সমমানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

২৩. অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট সংস্কার করতে হবে। বটতলা-শহিদ রফিক জব্বার/রবীন্দ্রনাথ হলের রাস্তা প্রশস্তকরণ করতে। চলাচলের জন্য রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান সড়কগুলোতে দুইলেন এবং ফুটপাথের ব্যবস্থা করতে হবে। যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।  জলনিষ্কাশন ও কেন্দ্রীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।

২৪. ক্যাম্পাসে অবস্থিত ক্যান্টিন, ডাইনিং এবং খাবার দোকানের খাবারে মান উন্নত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। ক্যাফেটেরিয়ার সার্বিক সংস্কার এবং বিকালের নাস্তার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত দোকানসমূহের পুরোনো লিজ বাতিল করে এ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

২৫. রেজিস্ট্রার ভবন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর ইত্যাদিতে সেবার ক্ষেত্রে সকল অনিয়ম, সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম চালু করতে হবে।

২৬. ক্যাম্পাসে ছিনতাই, চুরি ও মাদক প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পুরো ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত হত্যাকাণ্ড, হামলা, যৌন হয়রানি, র্যাগিংসহ অন্যান্য অপরাধ কার্যক্রমের সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

২৭. কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করলে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি ‍‍`একাডেমিক অবজারভেশন সেল‍‍` গঠন করতে হবে এবং এ সেলে অবশ্যই ছাত্রপ্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ‍‍`একাডেমিক অবজারভেশন সেল‍‍` স্বাধীনভাবে কাজ করে অপরাধ বিবেচনা করে প্রচলিত আইনে শাস্তির সুপারিশের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারবে।

২৮.  প্রত্যেক অনুষদে ডীনস অ্যাওয়ার্ড চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্টার্ট-আপ বা উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিং এর নিয়ম চালু করতে হবে।

২৯. বিভাগে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ইলেকট্রনিক সিস্টেম চালু করতে হবে। দুপুর ১.১৫ টায় ঢাকাগামী শিক্ষক বাসের পরিবর্তে বিকাল তিনটায় চালু করতে হবে।

৩০. নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করতে হবে। সমাবর্তনের সার্বিক ব্যবস্থা, পোশাক, খাদ্য ইত্যাদির মানোন্নয়ন করতে হবে।

৩১. পরীক্ষার সময়সূচি ১০.০০-২.০০ করতে হবে।

৩২. স্বৈরাচারী আমলে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট পুনর্গঠন করতে হবে এবং নিয়মিত সিনেট নির্বাচন দিতে হবে।

৩৩. দক্ষ ও শিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল গঠন করতে হবে৷ এ কাউন্সিল দেশে-বিদেশে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জনবল প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দেওয়ার শর্তে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করবে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম বৃদ্ধি করতে হবে৷

৩৪. কেবল মেধাভিত্তিক বৃত্তি নয়, দারিদ্র্য অসচ্ছলতার ভিত্তিতেও বৃত্তির বন্দোবস্ত করতে হবে এবং বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।

৩৫. আন্তর্জাতিক জার্নালে মানসম্মত গবেষণা  পাবলিকেশনের জন্য শিক্ষার্থীদেরও আর্থিক সহযোগিতার বন্দোবস্ত করতে হবে এবং এর সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও বণ্টন করতে হবে।

৩৬. প্রত্যেক বিভাগে নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে কোর্স চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক ইয়াহিয়া জিসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আমরা যে ৩৬ দফা নির্ধারণ করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমরা সেই দফাগুলোর যৌক্তিকতা উপস্থাপন ও একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছি। প্রশাসন আমাদের স্বাগত জানিয়েছে এবং কথা দিয়েছে যে তারা অবিলম্বে এই দফা গুলো বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করবেন।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আমাদের যে দাবি গুলো আছে, সেগুলো কোনোটি কয়েকদিনেই বাস্তবায়ন সম্ভব, আবার কোনোটির ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সময় লাগতে পারে। আমরা বলেছি যে, আমরা ৩০ দিন পর আবার আসবো। আমরা ১ মাসের মধ্যে একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। এজন্যই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ৩০ দিনের একটি সময়সীমা বা আল্টিমেটাম দিয়েছি।

বিআরইউ