দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে চলছে কানাঘুঁষা, কি হতে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। একটু পরেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বাংলোতে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের ব্যক্তিগত শয়নকক্ষে সন্ধান মিলে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার একাধিক ওএমআর শিটের।
১৭ অক্টোবর বাংলো থেকে সাবেক এই উপাচার্যের যাবতীয় সরঞ্জামাদি পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সময় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ওএমআর শিটগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়। অথচ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ওএমআর শীটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলোর রক্ষাকর্তা হওয়ার কথা ছিল সাবেক এই উপাচার্যের। কিন্তু তিনি রক্ষকের ভূমিকা পালন না ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। অভিযোগ উঠেছে এসব ওএমআর দিয়ে তিনি ভর্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীদের ভর্তি করাতেন। এসময় শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের নথিপত্র এবং প্রার্থীদের তালিকার সন্ধানও পাওয়া যায়, যা সংরক্ষিত রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ওএমআর উপাচার্যের নিকট কিংবা বাসভবনে যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকলেও অনুসন্ধানে জানা যায়, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আগেই ওএমআর পৌঁছে যেতো সাবেক এই উপাচার্যের কাছে। এসব ওএমআর দিয়ে ভিসি বাংলোতে বসে পছন্দের প্রার্থীদের পরীক্ষা নিতেন এবং সাবেক এই উপাচার্য নিজেই কখনো পরীক্ষা দিতেন। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পূর্বেই প্যাকেজিং এর সময় সাবেক উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখরের কাছে এবং উপাচার্য দপ্তরে ২০টিরও অধিক ওএমআর শিট দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট কমিটির একাধিক সদস্য।
সংশ্লিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিবের কারসাজিতেই সাবেক উপাচার্যের নিকট পরীক্ষার আগেই ওএমআর পৌঁছে যেতো বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক। অন্যদিকে উপাচার্যের নিকট এই ওএমআর পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ প্যাকেজিং কমিটির সদস্য সচিব মাসুদ রানার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্যাকেজিং কমিটির একাধিক সদস্য জানান, কমিটির সদস্যরা শুধুমাত্র রুম প্রতি ওএমআর প্যাকেজিং করতেন। বাকি যাবতীয় হিসাব রাখতেন কমিটির সদস্য সচিব মাসুদ রানা। তিনি একদিন এসে উপাচার্যের কথা বলে ওএমআর নিয়ে গেছেন। পরীক্ষার হল থেকে ফেরত আসা ওএমআরগুলো কোথায় সেগুলোর তথ্যও নেই কারো কাছে।
অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করলেও ৩-৪ টি ওএমআর কন্ট্রোল রুমে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোল্লা আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্বে থাকেন। এছাড়াও কয়েকজন ফোকাল পয়েন্টের অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। ওএমআর প্যাকেজিং এর সময় ৩-৪ টা বাড়তি দেওয়া হয়েছে কন্ট্রোল রুমে। কিন্তু ভিসি স্যারের বাংলোতে ওএমআর কিভাবে গেলো সে বিষয়ে অবগত নই।
ভিসির বাসভবনে ওএমআর পাওয়ার বিষয়ে সদস্য সচিব মাসুদ রানা বলেন, আমি এটি জানি না। আমাদের কাজ হলো ওএমআর নিয়ে রুমপ্রতি ভাগ করে দেয়া। যে-সকল ওএমআর অব্যবহৃত থাকে, সেগুলো একসাথে সেন্ট্রালে পাঠানো হয়। আমার কাছে এর কোনো হিসাব নেই।
এছাড়াও সাবেক উপাচার্যের পরিবারের নিকট সরঞ্জামাদির হস্তান্তরের সময় অনুসন্ধান ছাড়াই ওএমআরসহ এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি পরিবারের নিকট হস্তান্তরের চেষ্টা এবং সাংবাদিক প্রবেশে বাধা দেন সাবেক এই উপাচার্যের অনুসারী সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আরিফুর রহমান।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের ঘটনা ন্যাক্কারজনক। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই বিষয়টি তদন্ত করে যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে প্রশাসন অবগত রয়েছে। ভিসি বাংলো থেকে পাওয়া সাবেক উপাচার্যের অফিসিয়াল নথিপত্র সংরক্ষিত রাখা আছে। বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
উল্লেখ্য, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভর্তি-বাণিজ্য এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষ লেনদেন ও দুর্নীতির অভিযোগে অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আরএস