গল্প, গান, নাকি অভিনয়—কোনটা সেরা? ‘অভিমান’ সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে গেলে বিষয়টি বেকায়দায় ফেলে। ‘অভিমান’ সেই বলিউড সিনেমা, যেটা দেখতে বসলে কোনো জটিলতা ছাড়াই গল্পের ভেতরে চলে যাওয়া যায়। গানগুলোতে সে কী মায়া! অমিতাভ, জয়া পাল্লা দিয়ে অভিমান করেছেন, অভিনয় করেছেন।
১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই মুক্তি পায় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিমান’। মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৫০টি বছর। অমিতাভ-জয়ার মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘অভিমান’ এখনো চর্চিত দর্শকদের কাছে। এখনো ইউটিউবে এ ছবির গান শোনেন শ্রোতারা। গত বছর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী সিনেমা ছিল ‘অভিমান’।
এ সিনেমার বাঙালি যোগটা দারুণ। পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জি বাঙালি। সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীন দেববর্মন। আর জয়া তো বাঙালিই। সিনেমার গানে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়েছিলেন সংগীত পরিচালক, ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না’ গানটি পুরোপুরি ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ গানের সুরের আশ্রয়ে।
পরিচালকের কথাটা আলাদা করে একটু বলি। হৃষিকেশ মুখার্জির শুরুটা কলকাতার নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে, ক্যামেরাম্যান হিসেবে। একসময় পাড়ি দেন মায়ানগরী মুম্বাইয়ে। পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো-বিঘা জামিন’-এ চিত্রনাট্যকর ও সম্পাদনা এবং ‘দেবদাস’-এর সম্পাদনার কাজ করেছেন। সেই যে শুরু, একসময় তিনিই হয়ে ওঠেন বোম্বাইয়ের সিনেমায় ‘স্টারমেকার’। রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, অমল পালেকর, জয়া ভাদুড়ির (বচ্চন) মতো তৎকালীন নবীন প্রতিভাবানদের নিয়ে কাজ করেন। বানিয়েছেন ‘সত্যকাম’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘অনুপমা’, ‘আনন্দ’, ‘অভিমান’, ‘গুড্ডি’, ‘গোলমাল’, ‘আশীর্বাদ’, ‘বাবুর্চি’, ‘নামক হারাম’-এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমা।
‘অভিমান’ সিনেমার বাঙালি যোগটা দারুণ। পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জি বাঙালি। সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীন দেববর্মন। আর জয়া তো বাঙালিই।
অমিতাভ-জয়া তখন নবদম্পতি। তার আগে তাঁদের বন্ধুত্ব। ঠিক করলেন, নিজেরাই নিজেদের ছবি প্রযোজনা করবেন। অমিতাভ আর জয়ার মিলিত নামে হলো ‘অমিয়া’। অমিয়া থেকে প্রথম বানানো হলো অভিমান।
স্মৃতিচারণে অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ক্যারিয়ারের মনে রাখার মতো এই ছবি “অভিমান”। পরিচালক হৃষিদার কাজ, সুরকার শচীন দেববর্মনের অসম্ভব ভালো সুর, সব মিলিয়ে খুব জমাটি ব্যাপার। আমার মনে আছে, আমাদের প্রোডাকশন সংস্থার নাম ছিল অমিয়া—অমিতাভের ‘অমি’ আর জয়ার ‘য়া’ মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সংস্থা।’
অনেকে বলেন ‘অভিমান’ সত্য ঘটনা অবলম্বনে। আসলে কি তা-ই? ‘অভিমান’ ছবির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসি ও রেডিফে প্রকাশিত দুটি আলাদা নিবন্ধেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। দুজন গায়ক-গায়িকার জীবনকাহিনির নির্যাস নিয়েই অভিমান।
১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই মুক্তি পায় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিমান’। আইএমডিবি
তাঁরা কি কিশোর কুমার ও রুমা গুহঠাকুরতা? কিশোর-রুমা ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। রুমা সে সময়ের জনপ্রিয় গায়িকা-নায়িকা। কিশোর কুমারও তা-ই, গায়কের মতো তিনি নায়ক হিসেবেও সফল। বিয়ের পর রুমা মুম্বাইতে কিশোরের সঙ্গে সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বিয়ে টেকেনি নানা কারণে। অনেকে এই ছবির গল্পে সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও তাঁর প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর মিল পান। যেখানে দুজনই অসামান্য প্রতিভাবান।
‘অভিমান’ সিনেমা দেখা যায়, সুবীর (অমিতাভ) তরুণ জনপ্রিয় গায়ক। একদিন বেরিয়ে যায় গাড়ি নিয়ে, চলে যায় গ্রামে। তার দুর্গা মাসির বাড়িতে দেখা হয় উমার (জয়া ভাদুড়ি) সঙ্গে। উমা শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা করে, ছোট্ট এক নদীর পাড়ে সুবীর মুগ্ধ হয় তার গানে। পরিচয় হয়, প্রেমও। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করে উমাকে শহরে নিয়ে আসে। এই সময়ের দৃশ্য, সংলাপগুলো ভোলার নয়। জয়া বচ্চনের মিষ্টি হাসি, সকালে ভেজা চুলে অমিতাভের সামনে সলাজ উপস্থিতি, মধ্যরাতে নারী ভক্তের ফোনে স্ত্রীর অনুযোগ, সকালে নতুন গান বাঁধা, খুনসুটির।
একসময় সুবীরই উমাকে গানের জগতে নিয়ে আসে। খুব দ্রুত সুনাম ছড়িয়ে পড়ে উমার। এমনও হয়, মিলনায়তনে ভক্তরা অটোগ্রাফ নিচ্ছিল সুবীরের কাছে। ওই সময় উমাকে দেখতে পেয়ে সুবীরের ভক্তরা অটোগ্রাফ বই ছিনিয়ে নিয়ে উমার দিকে এগিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত তারকা সুবীর আর নবীন উমার হাত ধরাধরি করে অনুষ্ঠানে গেলেও আলোকচিত্রীরা উমাকে আলাদা করে একা ছবি তোলে। সুবীর মনে করে, তার ক্যারিয়ার পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে উমার ক্যারিয়ার তরতর করে উঠছে! একজন প্রযোজক উমাকে প্রতি গানের জন্য পাঁচ হাজার টাকা প্রস্তাব দেয়।
এসব ছোট ছোট ঘটনায় তৈরি হয় টানাপোড়েন। সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হলে উমা গ্রামে চলে যায় অভিমান করে। উমার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়। অনুতপ্ত সুবীর তাকে ফিরিয়ে নিয়ে। কিন্তু আবেগ-অনুভূতিহীন উমা কিছুতেই স্বাভাবিক হয় না। কণ্ঠে সুর আসে না তার। একদিন সুবীর একটি স্টেজ শো করে, যেখানে সে তাদের দুজনের প্রিয় গানটি শোনায়—তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না...।
স্মৃতিচারণে অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ক্যারিয়ারের মনে রাখার মতো এই ছবি “অভিমান”। পরিচালক হৃষিদার কাজ, সুরকার শচীন দেববর্মনের অসম্ভব ভালো সুর, সব মিলিয়ে খুব জমাটি ব্যাপার। আমার মনে আছে, আমাদের প্রোডাকশন সংস্থার নাম ছিল অমিয়া—অমিতাভের ‘অমি’ আর জয়ার ‘য়া’ মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সংস্থা।’
‘অভিমান’ নিয়ে এখনো কথা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অমিতাভ-জয়া দুজনেই তাঁদের ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন মনে করেন এ সিনেমাকে। এক সাক্ষাৎকারে নির্মাতা করণ জোহর প্রিয় সিনেমা উল্লেখ করে বলেন, ‘অসংখ্যবার “অভিমান” দেখেছি। যতবার আমি এটি দেখি, কেঁদে ফেলি।’ বিদ্যা বালান নয়বার দেখেছেন, তাঁর ভাষায় এটি চিরন্তন ছবি। দাম্পত্য জীবনে অহংকার, দাম্ভিকতা প্রায় চলে আসে। বিশেষ করে ভারতের মতো একটি সমাজে, যেখানে বেশির ভাগ পুরুষ তাঁদের স্ত্রীর সাফল্যে অস্বস্তিতে পড়েন।’ ১৯৭৪ সালে ‘অভিমান’-এ অভিনয়ের জন্য সেরা নারী শিল্পী হিসেবে জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেন। শচীন দেববর্মন জিতেন সেরা সংগীত পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড। ইউটিউবে ছবিটি পাওয়া যায়, গানগুলোও আলাদা করে মিলবে।