সিনেমার আঁতুড়ঘর খ্যাত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) আর কখনোই পা রাখবেন না- গত বছরের মাঝামাঝি এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান। এরপর তিনি আর এফডিসিতে আসেননি। অভিমান করেছিলেন তিনি। সেই অভিমান যে আর ভাঙবে না, তা হয়ত কারো জানা ছিল না। অবশেষে এফডিসিতে এলেন অঞ্জনা। তবে সেই চঞ্চল ও সদা হাসি মাখা মুখ নিয়ে নয়। এলো তার নিথর দেহ।
৬০ বছর বয়সে শুক্রবার দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অঞ্জনা। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এফডিসিতে আনা হয় তার মরদেহ। লাশবাহী গাড়ি এফডিসিতে পৌঁছানোর পর ভারী হয়ে ওঠে পুরো চত্ত্বর। কান্নায় ভেঙে পড়েন দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা।
অঞ্জনাকে শেষ বিদায় জানাতে এফডিসিতে এসেছিলেন নায়ক আলমগীর, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মিশা সওদাগর, মেহেদী, জয় চৌধুরী, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, রিয়ানা রহমান পলি, অভিনয়শিল্পী সুব্রত, নাসরিন, রোমানা মুক্তি, পরিচালক ছটকু আহমেদ, শাহিন সুমন, মুশফিকুর রহমান গুলজার, চয়নিকা চৌধুরীসহ চলচ্চিত্র ও অভিনয় জগতের অনেকে।
দুপুর ১ টার দিকে এফডিসিতে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রঙ্গনে। দুপুর আড়াইটার দিকে সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
অঞ্জনার স্মৃতিচারণ করে চিত্রনায়িকা নূতন বলেন, ‘একই সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পথচলা। আমরা দু’জন বোনের মতো ছিলাম। যেখানেই যেতাম, আমরা এতো হাসিঠাট্টা করতাম, সবাই ভাবত আমরা আপন দুই বোন। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে শেষবার দেখা হয়েছিল। আর দেখা হবে না ভাবতেই শূন্যতা অনুভব করছি।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর বলেন, ‘অঞ্জনা আপার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। একজন ভালো শিল্পীর বাইরে অসম্ভব ভালো একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তার প্রাণবন্ত ও হাসিমাখা মুখ মিস করব। সবাই তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন।’
অঞ্জনার অভিমাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে। গেল কয়েকটি কমিটিতে ছিলেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২৪-২৬ মেয়াদি নির্বাচনে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে হেরে কষ্ট পান এই অভিনেত্রী। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই পরাজয় অপমানজনক মনে হয় অঞ্জনার। তাই কখনো বিএফডিসিতে পা না রাখার পণ করেছিলেন গুণী এই অভিনেত্রী।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক সময়ে ঢাকাই সিনেমার অন্যতম মুখ ছিলেন অঞ্জনা রহমান। নৃত্যশিল্পী থেকে নায়িকা হয়ে সর্বাধিক যৌথ প্রযোজনা এবং বিদেশি সিনেমায় অভিনয় করা একমাত্র দেশীয় চিত্রনায়িকাও তিনি।
অঞ্জনার অভিনয়জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘সেতু’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। তবে অঞ্জনা অভিনীত ও একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘দস্যু বনহুর’। ছবিতে তার নায়ক ছিলেন সোহেল রানা। এ ছবির পর তাকে আর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হয়নি।
১৯৭৬ সালের এই সিনেমার পর টানা কাজ করেছেন অঞ্জনা। একে একে অভিনয় করেন মাটির মায়া, অশিক্ষিত, চোখের মণি, সুখের সংসার, জিঞ্জির, অংশীদার, আনারকলি, বিচারপতি, আলাদীন আলীবাবা সিন্দাবাদ, অভিযান, মহান, রাজার রাজা, বিস্ফোরণ, ফুলেশ্বরী, রাম রহিম জন, নাগিনা ও পরীণিতার মতো বাণিজ্য সফল সিনেমায়।
অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আন্তর্জাতিক পুরস্কার, একাধিক জাতীয় স্বর্ণপদক ও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন।নৃত্যশিল্পী হিসেবেও অঞ্জনা পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি। পরিণীতা ও গাঙচিল-এ অভিনয়ের জন্য দু’বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। অঞ্জনা বিয়ে করেন পরিচালক আজিজুর রহমান বুলিকে। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
আরএস