স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা

ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীরা

মো. সোহাগ বিশ্বাস প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৩, ০৮:২৬ পিএম

১২ বছরে অভিযোগ পড়েছে ২৬৮টি
নিস্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৪ টি
বিড়ম্বানায় অধিকাংশই অভিযোগ করে না

সিজার ছাড়া স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। সোশ্যাল মিডিয়ায় চমকপ্রদ ভিডিও দেখে কুমিল্লা থেকে ছুটে এসেছিলেন রাজধানীর সেন্ট্রাল হসপিটালে। কিন্তু সেই ডা. সংযুক্তা সাহার প্রতারণা ও হসপিটাল কর্তৃপক্ষের  ভুল চিকিৎসায় আর বাড়ি ফেরা হলো না আঁখি ও তার নবজাতকের। এ ঘটনায় নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে। প্রশ্ন উঠছে স্বাস্থ্যখাতের নানা অব্যবস্থাপনা নিয়েও। আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজেদের গাফেলতির কথা স্বীকার করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশও করেছে হাসপাতালটি। মা-মেয়ের চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়ে কোন সদুত্তোর দিতে পারেনি হাসপাতালটির সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. এ টি এম নজরুল ইসলাম।

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, আঁখির চিকিৎসায় হাসপাতালের অবশ্যই গাফেলতি ছিল। প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার গাফেলতি প্রধান। দ্বিতীয়ত, অপারেশন থিয়েটারে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেননি।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫ দিন চলে গেছে, আর বাকি আছে দুই দিন। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে। 
হাসপাতালের পক্ষ থেকে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, আমাদের তদন্ত কার্যক্রম তো এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট এলে আমরা একটা অ্যাকশনে যাব।
একজন চিকিৎসকের পক্ষে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ রোগী দেখা কতটা সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে গেলে একজন চিকিৎসকের দৈনিক এত রোগী দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু সংযুক্তা সাহা দেখতেন, কী বলব আর এটি নিয়ে।
বর্তমানে বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত খাদের কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে। সেবার নামে প্রতিদিন চলছে প্রতারণা। রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা মরিয়ম খাতুন। উচ্চরক্তচাপ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। গত মে মাসে বাথরুম থেকে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। এরপর তিনি রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে ওই হাসাপাতালের ফিমেল অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে ভর্তি হন। প্রায় দুই সপ্তাহ পর হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সার্জন ডা. জাকির হোসেনের তত্ত্বাবধানে ভাঙ্গা পায়ের অপারেশন হয় । গত ২৯ মে অপারেশন শেষে রোগীর জ্ঞান ফিরলে দেখা যায় চিকিৎসক ভাঙা পায়ের পরিবর্তে ভালো পায়ের অপারেশন করে ফেলেন। দুই পায়ের ভোগান্তি নিয়ে এখন মরিয়ম খাতুন শয্যাশায়ী। ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের গাফেলতি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী পরিবার। কিন্তু এখনো তা তদন্তের মধ্যেই আটকে আছে। 
এভাবেই বেশিরভাগ ঘটনাই আটকে থাকে তদন্তের মধ্যে। আবার মিডিয়ার সামনে আসেনা অধিকাংশ ঘটনা। 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১২ বছরে বিএমডিসিতে অভিযোগ পড়েছে ২৬৮টি। এর মধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৪ টি। তবে অধিকাংশই অভিযোগ নিয়ে আসেনা। 
ভুল চিকিৎসায় নবজাতক মৃত্যুর ঘটনায় গত শুক্রবার সেন্ট্রাল হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. মো. দাউদ আদনান ও উপ-পরিচালক ডা. মঈনুল আহসানের নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় হাসপাতালটির আইসিইউ এবং জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। একই সঙ্গে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধের নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অথচ তার দুই দিনের মাথায়  আইসিউ বিভাগের সকল কার্যক্রম চালু হয়েছে বলে নোটিশ দেয় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত রোববার আঁখির মৃত্যু হয় ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এমন প্রেক্ষাপটে আইসিইউ কিভাবে খোলা হয়েছে এমন প্রশ্নে  স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালে আইসিইউ পরিচালনার বিষয়টি আমার জানা নেই। তদন্ত চলা অবস্থায় এটি চালু করা অন্যায়। তাহলে প্রশ্ন উঠছে  স্বাস্থ্যখাতের নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে। দিনের পর দিন ডাক্তাররা অন্যায় করলেও ব্যবস্থা নিতে উদাসীন বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।

আরএস