সামরিক শক্তিতে কোন দেশ এগিয়ে?

উত্তেজনা কমাতে একমত পাকিস্তান ও ইরান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪, ০৯:৩৯ পিএম

হামলা ও পাল্টা হামলার কারণে দুই প্রতিবেশী দেশ ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কমাতে একমত হয়েছে তারা। শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) এক ফোনকলে আলোচনার পর তারা এই ঐক্যমত পোষণ করে।

পাকিস্তানভিত্তিক গণমাধ্যম জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসাইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের সাথে চলমান সঙ্কট নিয়ে কথা বলেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস জিলানি। 

এ সময় তারা চলমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। একইসাথে যাবতীয় ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার সম্মতি প্রদান করেন। এ সময় উভয়ই জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন।

এদিকে, পাকিস্তান ও ইরানের মাঝে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) পাকিস্তানভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য নিউজের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, চীন আন্তরিকভাবে কামনা করে যে উভয় পক্ষ সংযম অবলম্বন করবে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়িয়ে চলবে। তবে উভয় পক্ষ যদি চায়, তাহলে চীন উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। 

পাকিস্তান-ইরান: সামরিক শক্তিতে কোন দেশ এগিয়ে?

মঙ্গলবার (১৬ই জানুয়ারি) রাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তবর্তী এক শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। সেই হামলায় পাকিস্তানে দুই শিশুর মৃত্যু এবং তিনজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার।

ইরানের দাবি, পাকিস্তান ভিত্তিক সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করেই তারা এই হামলা চালিয়েছে। এই গোষ্ঠীটি পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়, যারা সবসময় ইরানের সরকারের বিরোধিতা করে। এরা নিজেদেরকে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে ‘সুন্নি অধিকার রক্ষক’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

ঐ হামলার দু’দিন পর, অর্থাৎ গত ১৮ই জানুয়ারি নিজেদের ভূ-খণ্ডে ইরানের হামলার বিপরীতে দেশটিতে ‍‍`প্রতিশোধমূলক‍‍` পাল্টা রকেট ও ড্রোন হামলা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান।

বৃহস্পতিবার ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন শিশুও রয়েছে। যদিও ইরানের ন্যায় পাকিস্তান এ হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বলেছে।

অনেকে ধারণা করছে, দুই দেশের পাল্টা-পাল্টি আক্রমণে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। যুদ্ধে কোন দেশের কতটা সক্ষমতা রয়েছে এ নিয়ে নেটিজেনদের আগ্রহ রয়েছে।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৪ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের স্থান নবম। অন্যদিকে, ইরানের অবস্থান ১৪তম।

৬০টির বেশি উপাদান নিয়ে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। এতে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, স্থানীয় শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর্মক্ষমতা এবং প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মর্যাদার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

সৈন্য সংখ্যা

সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে ইরানের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর সর্বমোট সদস্য হলো ১৭ লাখ। এর মাঝে সক্রিয় সেনা সদস্য সাড়ে ছয় লাখ এবং রিজার্ভে আছে সাড়ে পাঁচ লাখ। এছাড়া আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য আছে পাঁচ লাখ।

অন্যদিকে ইরানের সামরিক বাহিনীর সদস্য হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ। এর মাঝে সক্রিয় আছে ছয় লাখ ১০ হাজার এবং রিজার্ভে আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য দুই লাখের বেশি ।

ইরানের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের চেয়ে বেশি।

ইরান ও পাকিস্তান, এই দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটে বড় পার্থক্য রয়েছে। ইরানের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের চেয়ে বেশি।

ইরানের প্রতিরক্ষা বাজেট ৯৯৫ কোটি ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ডলার। এই র‍্যাংকিংয়ের দেশগুলোর মাঝে দেশটি ৩৩তম অবস্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে, জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম সারির হলেও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ রয়েছে ৬৩৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৯ ডলার। এক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান ৪৭তম।

যুদ্ধ বিমানের সংখ্যায় এগিয়ে পাকিস্তান
ইরানের মোট সামরিক বিমান রয়েছে ৫৫১টি, আর পাকিস্তানের রয়েছে এক হাজার ৪৩৪টি বিমান।

কিন্তু এসবের মধ্যে শুধু যু্দ্ধবিমান ইরানের রয়েছে ১৮৬টি। অন্যদিকে পাকিস্তানের আছে ৩৮৭টি।

ইরানের আক্রমণকারী বা অ্যাটাকিং বিমান রয়েছে ২৩টি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের আছে ৯০টি।

তবে পরিবহনের জন্য ইরানের বিমান সংখ্যা বেশি। তাদের রয়েছে ৮৬টি বিমান। কিন্তু পাকিস্তানের আছে ৬০টি।

হেলিকপ্টার বেশি পাকিস্তানের

দুই দেশের সামরিক বাহিনীর কাছেই সাধারণ হেলিকপ্টার রয়েছে। এর মাঝে ইরানের আছে ১২৯টি। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে তিনগুণ বেশি, অর্থাৎ ৩৫২টি বিমান রয়েছে।

আক্রমণকারী বা অ্যাটাকিং হেলিকপ্টারের দিক থেকেও পিছিয়ে ইরান। ইরানের মোট আক্রমণকারী হেলিকপ্টার রয়েছে ১৩টি, যেখানে পাকিস্তানের আছে ৫৭টি।

ট্যাংকে পাকিস্তান ও সাঁজোয়া যানে ইরান এগিয়ে

পাকিস্তানের মোট ট্যাংকের সংখ্যা ৩ হাজার ৭৪২টিচ। ইরানের রয়েছে এক হাজার ৯৯৬টি। এরকম বাহন ইরানের রয়েছে ৬৫ হাজার ৭৬৫টি, আর পাকিস্তানের ৫০ হাজার ৫২৩টি।

আর্টিলারিতে এগিয়ে পাকিস্তান

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তালিকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দিক বিবেচনায় পাকিস্তান অনেকটা এগিয়ে।

ইরানের সেলফ-প্রোপেলড আর্টিলারি আছে ৫৮০টি, পাকিস্তানের ৭৫২টি। ইরানের টাওড আর্টিলারি (টেনে নিয়ে যাওয়ার কামান) আছে দুই হাজার ৫০টি, পাকিস্তানের তিন হাজার ২৩৮টি।

তবে ইরানের রকেট আর্টিলারি আছে ৭৭৫ টি থাকলেও পাকিস্তানের আছে মাত্র ৬০২টি।

যুদ্ধ জাহাজ পাকিস্তানের বেশি

ইরানের ফ্রিগেট (দ্রুতগামী মাঝারি যুদ্ধজাহাজ) রয়েছে সাতটি, পাকিস্তানের নয়টি।

ইরানের কর্ভেট (ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ) আছে তিনটি, পাকিস্তানের সাতটি।

ইরানের সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ আছে ১৯টি, কিন্তু পাকিস্তানের আছে আটটি।

ইরানের প্যাট্রোল নৌযান (টহল জাহাজ) আছে ২১টি, পাকিস্তানের আছে ৬৯টি।

ইরানের কোনও ডেস্ট্রয়ার না থাকলেও পাকিস্তানের দুইটি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে।

ইরানের মাইন যুদ্ধজাহাজ রয়েছে একটি, পাকিস্তানের আছে তিনটি।

এসব যুদ্ধযানের মধ্যে ইরান ও পাকিস্তান, কারও কোনও বিমানবাহী রণতরী নেই।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এরপরেই রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, তুরস্ক, ও ইতালি।

পারমাণবিক শক্তি ধর দেশ পাকিস্তান

বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে।

সুইডেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)‍‍`র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শুরুতে বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে।

দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েল।

এই তালিকায় পাকিস্তানের নাম থাকলেও ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই ছিলো না।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার দাবী করেছে যে ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের মজুদ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।

এদিকে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেনি যে কোন দেশের হাতে কতটি এ ধরণের অস্ত্র রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার বিষয়টি তারা তাদের রিপোর্টে বিবেচনায় নেয়নি।

সামরিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলে থাকেন যে পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেকটা ডেটেরেন্ট বা নিবৃত্তকরণের উপাদান হিসেবে কাজ করে, কারণ শেষ বিচারে এ ধরণের অস্ত্র কেউ ব্যবহার করতে চাইবে না।
সূত্র: বিবিসি

এইচআর