বাংলাদেশের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ছাত্র আন্দোলন। মূলত কলকাতার মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আরজিকরে`র এক ইন্টার্ন চিকিৎসক ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা সামনে আসার পর ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা।
মৌমিতা দেবনাথ নামের ওই ইন্টার্ন চিকিৎসকের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে প্রথমে কলকাতায় আন্দোলন শুরু হলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যজুড়ে। পশ্চিমবঙ্গের মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষও। বিভিন্ন জায়গায় কর্মবিরতি পালন করছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ফলে বন্ধ রয়েছে হাসপাতালগুলোর আউটডোর পরিষেবা।
মূলত শুক্রবার (৯ আগস্ট) সকালে কলকাতার আরজিকর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাছে চারতলার সেমিনার হলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রী মৌমিতার রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌমিতা বৃহস্পতিবারও রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডিউটি করেছিলেন। পরে কর্মরত আরও দুই জুনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে রাতের খাওয়া শেষ করে সেমিনার হলে যান তিনি। শুক্রবার সকালে সেমিনার হলের মেঝেতে তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পাওয়া যায়।
মৌমিতার মৃত্যুর ঘটনাকে প্রথমে আত্মহত্যা বলে পরিবারকে জানায় পুলিশ। পরে চাপের মুখে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে স্বীকার করে পুলিশ। তার শরীরে একাধিক ক্ষত চিহ্নও রয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। নিহত শিক্ষার্থীর বাবা দাবি করেন, তার মেয়ের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে জানিয়েছিল পুলিশ।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে অভিযুক্তের শাস্তি, নিরাপত্তা ও অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজসহ পশ্চিমবাংলার সরকারি হাসপাতালগুলো। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে একপ্রকার ভেঙে পড়ে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা। চাপের মুখে পদত্যাগ করেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিও তুলেছেন। সোমবার (১২ আগস্ট) মৌমিতা দেবনাথের বাড়ি যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাবা-মায়ের অভিযোগ, ওদের ভেতরেই কেউ আছে। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে। কারও হাত রয়েছে কি না, তা পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি পুলিশকে দেয়া বিশেষ নির্দেশে মমতা বলেছেন, `দরকারে ওর বন্ধুবান্ধবকে ডেকে কথা বলুন। যিনি ফোন করে সেদিন খবর দিয়েছিলেন, তার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। কাউকে ছাড়া হবে না।`
মমতা বলেছেন, `কীভাবে মেয়েটাকে মেরেছে! দ্রুত এর বিচার করতে হবে। আমরা ফাঁসি চাই। তাই ফাস্টট্র্যাক আদালতে তোলার কথা বলেছি। যাতে দ্রুত বিচার হয়। সমাজে এখনও অনেক লোক আছেন, যারা ভুলে গেছেন নারীদের গায়ে হাত দেয়া কত বড় অপরাধ। যে কারণেই ফাঁসির সাজা চাইছি।` তবে মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পরও খুশি হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি শাসকদলের একাধিক নেতার ছেলে এই ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে জড়িত। তাদের আড়াল করতেই কাজ করছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন।
এ অবস্থায় রাজ্যের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ পাঁচটি জনস্বার্থ মামলা একত্র করে এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেন। তারা জানান, এ মামলার হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হবে। প্রয়োজনে তদন্তের স্বার্থে অন্য রাজ্য থেকে সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আনা হবে। পরে বুধবার সকালে কলকাতা পুলিশের হাতে থাকা মামলাটির সব নথি আদালতের নির্দেশ মেনে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়া হয়।
এদিক চিকিৎসক হত্যার তদন্ত সিবিআই হাতে চলে যাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনায় প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা। মিছিলে অংশ নেন অভিনেতা কৌশিক সেন, বাদশা মৈত্র, চন্দন সেন অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, সমাজকর্মী মিরাতুন নাহার, মানবাধিকার কর্মী সুজাতা ভদ্রসহ অনেকে। এছাড়া জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরাও মৌমিতার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে শুরু থেকেই তথ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য পুলিশের তরফ থেকে নিছক আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে বলে দাবি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপি ও সিপিআইএম। আর পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র নীলাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে পারে সেই দৃষ্টান্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে শাসকদলের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদে নতুন ভাষা পায় আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক ছাত্র আন্দোলনের এমন ঘটনায় পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতের একাধিক রাজ্যের চিকিৎসকেরা। গুজরাট ,মহারাষ্ট্র ,উত্তর প্রদেশ, ছত্রিশগড়, কেরল ,রাজস্থান, কর্ণাটকের মতো রাজ্যে চিকিৎসকেরা সাময়িক কর্মবিরতি ঘোষণা করে অনেক জায়গায় পোস্টার ব্ল্যাকার নিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, বুধবার (১৪ আগস্ট) রাতে কলকাতাসহ বাংলার নানান শহরে আয়োজিত হতে চলেছে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি। স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে ১১ টা ৫৫ মিনিট থেকে কলকাতায়, যাদবপুর, অ্যাকাডেমি চত্বর, কলেজ স্ট্রিট সহ বাংলার নানান জায়গায় থেকে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে জমায়েত করবেন তারা।
আরএস